ইসলাম অবমাননার অভিযোগে হিন্দু যুবককে গণপিটুনি, পরে জেল

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.02.05
ঢাকা
200205_Hindu_Youth_Arrested-Bangla_1000.JPG ঢাকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সমাবেশ। বাংলাদেশে এই আইনের আওতায় প্রায়ই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। ১১ অক্টোবর ২০১৮।
[রয়টার্স]

ইসলাম বিরোধী মন্তব্য করার অভিযোগে দক্ষিণাঞ্চলীয় পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলায় এক হিন্দু যুবককে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাঁকে উল্টো গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে।

ওই যুবকের নাম অরুণ ঘরামি (২৩)। তিনি মঠবাড়িয়া উপজেলার ছোট শিংগা গ্রামের বিপুল ঘরামির পুত্র বলে বেনারকে জানান মঠবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু জাফর মো. মাসুদুজামান। পুলিশ বলছে, তাঁর বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সন্দেহের কারণে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫৪ ধারায় তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করেছে।

গত সোমবার সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়া উপজেলায় অরুণ ঘরামিকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। আক্রমণকারীরা তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলছিল, তিনি ইসলাম অবমাননা করেছেন। তবে কোথায়, কবে এবং কী মন্তব্য করেছেন তা সংশ্লিষ্ট কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেননি।

প্রশ্ন উঠেছে, ওই যুবককে যারা মারধর করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “হিন্দু ওই যুবককে গ্রেপ্তারের পরিবর্তে পুলিশের উচিত ছিল যারা ওই যুবককে গণপ্রহার করেছে তাদের গ্রেপ্তার করা। কারণ তথাকথিত ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে অনেক স্বার্থান্বেষী মহল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখল করতে চায়, নানারকম স্বার্থসিদ্ধি করার চেষ্টা করে।”

তবে স্থানীয় পুলিশ এ প্রসঙ্গে বলেছে, পরিস্থিতি এমন ছিল যে জনরোষ থেকে যুবককে রক্ষা করাটাই ছিল প্রথম কাজ। তারপরও পুলিশ পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

পিরোজপুর জেলার পুলিশ সুপার হায়াতুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ সদস্যরা গিয়েছিল। সেখানে দেখা যায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি। জনতার হাত থেকে যুবককে উদ্ধার করে থানায় নেওয়া হয়।”

তিনি বলেন, “যেহেতু তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি খুব সংবেদনশীল সেহেতু আমরা তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করি। মঙ্গলবার তাকে আদালতে চালান করে দেয়া হয়। আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করে।”

পুলিশ সুপার বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে যুবকটি জানায় যে, আক্রমণকারীদের সে চিনতে পারেনি। তবে সে বলেছে, আট মাস আগে ফেসবুকের একটি গ্রুপ চ্যাটে একটি মন্তব্য করেছিল। গ্রুপের অন্য সদস্যরা জানায়, ওই মন্তব্যে ইসলামের অবমাননা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “হয়তো ওই ঘটনার জেরে তাকে আক্রমণ করা হয়ে থাকতে পারে।”

হায়াতুল ইসলাম বলেন, “এখন পর্যন্ত আমরা তার বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধী মন্তব্যের অভিযোগ পাইনি। তবে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আমরা পরীক্ষা করে দেখছি সেখানে এমন কোনো মন্তব্য আছে কি না।”

তিনি বলেন, “যদি তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া না যায় তাহলে সে আদালতের আদেশ সাপেক্ষ মুক্তি পাবে।”

অরুণ ঘরামির পিতা বিপুল ঘরামি বেনারকে বলেন, “আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। তাকে মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হয়েছে। পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পায়নি। তাকে মুক্তি দেয়া হোক।”

‘৫৪ ধারা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যমান দণ্ডবিধির ৫৪ ধারা দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি অন্যতম হাতিয়ার। এই ধারা বিলোপের দাবি দীর্ঘ দিনের। তবে, কোনো সরকারই এই ধারা বাতিল করেনি।

চুয়ান্ন ধারা অনুযায়ী, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “সুস্পষ্ট অভিযোগ ছাড়া একজন মানুষকে আটক রাখা মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাঁকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হোক। হয়তো তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বলে তাঁকে আটক রাখা হয়েছে।”

“আমি মনে করি, সরকারের উচিত প্রকৃত ঘটনা তদন্ত করে গ্রেপ্তার করা যুবকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, একজন হিন্দু যুবকের ফেসবুকে তাঁর নাম ব্যবহার করে ইসলামকে কটাক্ষ করার অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর তাণ্ডব চালানো হয়েছে।”

অধ্যাপক মিজান বলেন, “এর আগে একটি ভুয়া ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁদের বাড়িঘর, মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেখেছি, একইভাবে একজন হিন্দু যুবকের ফেসবুকে ভুয়া পোস্ট দিয়ে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে।”

তিনি বলেন, “একসকল আক্রমণের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়া। আমাদের উচিত এ ব্যাপারে সচেতন থাকা।”

“রাষ্ট্রের উচিত এব্যাপারে সচেতন থেকে এ ধরনের সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া,” মনে করেন ওই অধ্যাপক।

বাংলাদেশে ধর্মের অবমাননার অভিযোগ প্রায়ই উঠছে এবং মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ দুজন বাউল শিল্পীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে।

পালা গানে আল্লাহকে কটূক্তি করার অভিযোগে বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে সোমবার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। এর আগে গত ১১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার হন বাউল শরিয়ত বয়াতি, যাঁর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।