ফেসবুকে সংবাদ শেয়ার করায় সাংসদের মামলা, সাংবাদিক নিখোঁজ
2020.03.12
ঢাকা

ফেসবুকে সংবাদ শেয়ার করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ক্ষমতাসীন দলের এক সাংসদের মামলার পর গত তিন দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন ঢাকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত একটি খবর ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ার ঘটনায় অন্যদের সাথে তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেন সাংসদ।
সাংবাদিক কাজলের ছেলে মনোরম পলক বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “পরিবারের সদস্যরা মঙ্গলবার থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। তাঁর সন্ধানে আজও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমরা চকবাজার থানায় বসে ছিলাম। কিন্তু পুলিশ নতুন কিছুই জানাতে পারনি।”
“এখন পর্যন্ত বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি,” বেনারকে জানান চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার। তিনি বলেন, কাজলকে খুঁজে পেতে তাঁরা গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহায়তা চেয়েছেন।
কাজলের দুটি মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে ওসি বলেন, “তাঁকে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।”
“আমাদেরও থানা থেকে বলা হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে। যে কারণে আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি,” বলেন মনোরম।
চকবাজার থানায় বুধবার দায়ের করা সাধারণ ডায়েরিতে কাজলের স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসী বলেন, ১০ মার্চ (মঙ্গলবার) দুপুর আড়াইটার দিকে কাজল লালবাগের বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন। এরপর থেকে তাঁর আর খোঁজ নেই।
এর আগে সোমবার রাতে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন মাগুরা-১ আসনে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মো. সাইফুজ্জামান শেখর।
ওই মামলায় সাংবাদিক নয়, বরং ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে শফিকুল ইসলাম কাজলকে তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানান শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম মুন্সি।
“কাজলের হারিয়ে যাওয়ার সাথে আইন কানুনের দৃশ্যত কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এই হারিয়ে যাওয়ার সাথে প্রভাবশালী মহলের সম্পর্ক থাকাটা অস্বাভাবিক নয়,” বেনারকে বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার আলী আর রাজী।
তিনি বলেন, “যদি সামাজিক চাপ বড় আকারে তৈরি করা না যায়, তাহলে কাজলের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে তা ভাবতে ভয় হয়।”
কাজল ‘পক্ষকাল’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স ফটো সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করতেন।
এর আগে তিনি নিউ এজ, সমকাল ও বণিক বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন বলে বেনারকে জানান তাঁর বন্ধু জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক আবদুল্লাহিল কাইয়ুম।
কাইয়ুম জানান, সাম্প্রতিক সময়ে কাজল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফেসবুকে খুব সোচ্চার ছিলেন।
যা আছে মামলার এজাহারে
সাংসদ শিখরের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২ মার্চ দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর নির্দেশে আল আমিন নামের এক প্রতিবেদক ‘পাপিয়ার মুখে আমলা, এমপি, ব্যবসায়ীসহ ৩০ জনের নাম’ শীর্ষক সংবাদ পরিবেশন করেন।
প্রতিবেদনে ইঙ্গিতমূলকভাবে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, কুষ্টিয়া ও মাগুরা জেলার একজন করে সংসদ সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় ২৫ থেকে ৩০ জনের নামসহ একাধিক তালিকা প্রকাশ করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যেখানে শিখরের নামও রয়েছে।
এ ঘটনায় মানবজমিন সম্পাদক, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক এবং ফেসবুকে তালিকাগুলো প্রকাশ বা শেয়ার করা ৩০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে এজাহারে।
বাদির দাবি, অভিযুক্তরা পারস্পরিক যোগসাজশ করে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালিয়ে তাঁকে সমাজে হেয় করে হীনস্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা করেছেন।
এদিকে মতিউর রহমান চৌধুরী ও রিপোর্টার আল-আমিনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০ এপ্রিল দিন ধার্য করেছে আদালত। বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরাফুজ্জামান আনছারীর আদালত মামলার এজহার আমলে নিয়ে এ আদেশ দেয়।
প্রসঙ্গত, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়াকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর তাঁর পরিচালিত পাঁচতারকা হোটেলকেন্দ্রিক যৌনতার বাণিজ্য বিষয়ক কর্মকাণ্ড প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকার পৃথক তিন মামলায় স্বামী ও সহযোগীসহ কারাগারে আছেন তিনি।
সাংবাদিকদের ক্ষোভ, মন্ত্রীর সাফাই
গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মামলাটি দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। সংগঠনের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক নঈম নিজাম বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, “এই মামলা দায়ের করার মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ভীতি প্রদর্শন এবং হয়রানি করার অপচেষ্টা চলছে।”
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের এমন ব্যবহারের কারণেই সম্পাদক পরিষদ আইনটির বাস্তবায়ন শুরুর আগ থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, ওই সংবাদে সাইফুজ্জামান শিখরের নাম উল্লেখ করা হয়নি এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর সঙ্গে কোনো যোগসূত্রের বিষয় সেখানে উল্লেখ করা হয়নি।”
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কোনো অজ্ঞাত ব্যবহারকারী যদি কিছু করে থাকেন, তবে তার দায় কোনোভাবেই দৈনিক ‘মানবজমিন’-এর সম্পাদক বা প্রতিবেদকদের ওপর বর্তায় না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে।
সম্পাদক পরিষদ বিবৃতি দেওয়ার দিন ঢাকায় দলীয় এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কিছু কাল্পনিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আমি মনে করি, সত্যতা যাচাই না করে এ ধরনের কাল্পনিক তালিকা বা নাম প্রকাশ কোনোভাবেই সমীচীন নয়।”
“যদি কেউ করে থাকে, সেটি পত্রিকা হোক, অনলাইনে হোক বা অন্যভাবে হোক, সেটার দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। দায়িত্বহীনতার দায় নিতেই হবে,” উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, “কেউ সংক্ষুব্ধ হলে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেই পারেন। সেটি তাঁর সাংবিধানিক অধিকার।”
এর আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি এক বিবৃতিতে বলেন, “এই মামলাবিষয়ক পরবর্তী কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া এবং অবিলম্বে মামলাটি প্রত্যাহার করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।”
এই মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সরকার সমর্থক বলে পরিচিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং সরকারবিরোধী বলে পরিচিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশ।