ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি নাকচ করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
2020.07.01
ঢাকা

একের পর এক অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জোরদার হলেও এটি বাতিলের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ মঙ্গলবার আইনটি বাতিলের দাবি জানায়। পরদিন বুধবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইনটির অপপ্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি সেটি বাতিলের দাবি তুলেছে।
“আমরা মনে করি না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার প্রয়োজন আছে। এই আইন নাগরিকদের অনলাইনে সম্মানহানি থেকে রক্ষা করতে প্রণয়ন করা হয়েছে,” আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে কথাটা ঠিক না। এই আইনের আওতায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা আরেকজনের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবমাননাকর মন্তব্য লিখেছে। আর যারা সংক্ষুদ্ধ তারা মামলা করেছে।”
“এটি স্বাভাবিক যে মামলা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করবে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বুধবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই আইনটি অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমালোচক ব্যক্তিদের বিনা বিচারে আটক রাখা হচ্ছে।”
সংস্থাটির এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আইনের শাসনের পরিপন্থী কাজ করছে; বাছ বিচার না করে যারা সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সমালোচনা করছে তাঁদের আটক করছে।”
তিনি আরও বলেন, “কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যে যখন কারাগারে বন্দির সংখ্যা কমানো উচিত, সেই সময়ে কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করার দায়ে মানুষকে আটক করা হচ্ছে।”
অন্যদিকে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করায় সম্প্রতি সম্পাদকসহ সাংবাদিক, লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সম্পাদক পরিষদ মনে করছে, এতে করে অবাধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। পরিষদ আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে।
“করোনাকালে এখন পর্যন্ত ৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব গ্রেপ্তারের ঘটনা এমন এক ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে স্বাভাবিক সাংবাদিকতার কাজও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে,” বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্পাদক পরিষদের এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। বেনারকে তিনি বলেন, ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের মধ্যে বড়জোর চারজন সাংবাদিক, বাকিরা প্রকৃত সাংবাদিক নয় এবং তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য লিখেছে।
মামলা বেড়েই চলছে
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এই মামলা দায়েরের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
সংখ্যাটি ঠিক কত জানতে চাইলে, পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা বেনারকে বলেন, গত বছর এই আইনে ৭৩২ টি মামলায় এক হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি বলেন, “অনলাইন বা ডিজিটাল প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, গুজব রটানো ও মিথ্যাচার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করার চেষ্টার মতো সাইবার অপরাধের অভিযোগে এই মামলাগুলো করা হয়েছে।”
চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ১৬৫ মামলায় ৩৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান সোহেল রানা।
তবে পরবর্তী চারমাসে এই সংখ্যা কত সে সম্পর্কে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছে। এই প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বেনারকে বলেন, তাঁরা আশঙ্কা করছেন আগামী বছর মামলার সংখ্যা আরও বাড়বে।
“২০১৯ সালে আমরা প্রতিদিন গড়ে দুটি করে মামলা হতে দেখেছি, এখন হচ্ছে প্রায় তিনটি করে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করি,” আবু আহমদ ফয়জুল কবির বলেন।
এই আশঙ্কা কেন করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলাগুলো হয়রানিমূলক। স্থানীয় রাজনীতি, পারস্পরিক রেষারেষির কারণে এগুলোর বেশিরভাগ দায়ের হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিমের অসুস্থতা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক ফেসবুকে পোস্ট দেন তাঁর বাড়ি নড়াইল। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মামলা যিনি করেছেন তিনিও একই দলের। পেশায় আইনজীবী ওই ব্যক্তির বাড়িও নড়াইল বলে জানান তিনি।
তাছাড়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুম মুনিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির শিকার বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী। সিরাজুম বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অতি উৎসাহী হয়ে মামলা দায়ের করে বলে তাঁর ধারণা।
যেসব কারণে মামলা
চলতি বছরে দায়ের হওয়া ৫৪ টি মামলা পর্যালোচনা করে আসক’ এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ত্রাণ চুরি, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অনিয়ম, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করায় বা কার্টুন আঁকার কারণে বিভিন্নজন মামলায় আসামি হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নামে তীর্যক মন্তব্য করেও মামলার আসামি হয়েছেন কেউ কেউ।
বিএনপি ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভা কেমন হবে তা নিয়ে পোস্ট দেওয়ায় মামলা হয়েছে। তাছাড়া মুঠোফোনে কথা বলার খরচ বাড়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে পোস্ট করায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হয়েছে। ধর্ম অবমাননার অজুহাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন শরিয়ত বয়াতী।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এসব সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু হয়নি।
“আইনের প্রতিটা লাইন আমি পড়ে দেখেছি। খসড়া অবস্থাতেই অপপ্রয়োগের আশঙ্কার কথা বলেছি, সেই শঙ্কা বাস্তব হয়েছে। আইনের যে ধারাগুলোয় হয়রানি করা সম্ভব, শুধু সেগুলোর প্রয়োগ হচ্ছে,” জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন।
দুশ্চিন্তায় স্বজনেরা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে যারা কারাগারে আছেন, তাঁদের নিয়ে চিন্তায় আছেন স্বজনেরা।
কথা হচ্ছিল সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ছেলে মনোরম পলকের সঙ্গে। শফিকুল এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি মামলার আসামি, আছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
“কারাগারে এমনিই গাদাগাদি, বাবাকে যখন যশোর আদালতে তুলল একটা মাস্ক পর্যন্ত দেয়নি। এর মধ্যে রিমান্ডেও নিয়েছে। আমরা খুব চিন্তা করছি,” মনোরম পলক বেনারকে বলেন।
দুশ্চিন্তায় আছেন আহমেদ কবির কিশোরের স্বজনেরাও। তাঁর এক স্বজন বলেছেন, কিশোর ডায়াবেটিসে ভুগছেন। এর মধ্যেই তাঁকে কারাগারে থাকতে হচ্ছে। জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদও হয়েছে।