ব্লগার আসাদ নূরের পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ
2020.07.21
ঢাকা

উগ্রপন্থীদের হত্যার হুমকির মুখে দেশ ছাড়া ব্লগার আসাদুজ্জামান নূর ওরফে আসাদ নূরের (৩৮) পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। বরগুনা জেলার আমতলী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে আসাদ এই অভিযোগ করেছেন।
মঙ্গলবার বেনারকে স্কাইপে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসাদ জানান, শনিবার সকালে গ্রামের বাড়ি থেকে প্রথমে তাঁর বাবা তোফাজ্জল হোসেন ও মা রাবেয়া বেগমকে তুলে নেওয়া হয়। পরে ছোট দুই বোন, মামা এবং মামাতো ভাইকেও একই কায়দায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
“সবার ফোনও জব্দ করেছিল পুলিশ। পরে সোমবার গভীর রাতে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়,” বলেন আসাদ।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ভূমি দখল ও নির্যাতনের জন্য স্থানীয় সরকার দলীয় প্রভাবশালীদের দায়ী করে সম্প্রতি ফেসবুক ও ইউটিউবে ভিডিও প্রকাশ করেন আসাদ।
মূলত এ কারণেই তাঁর পরিবারকে দুইদিনের বেশি সময় ধরে আটকে রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে বলে আসাদের অভিযোগ।
“তাঁদের জিম্মি অবস্থায় রেখে পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক আমার বাবাকে দিয়ে আমার সাথে কথা বলিয়েছেন। বাবা তখন বললেন, আমি যেন সবগুলো ভিডিও মুছে ফেলি। যদি তা না করি তবে তাঁদের মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে,” বেনারকে বলেন আসাদ।
তবে আসাদের স্বজনদের আটকে রাখা বা তাঁর বাবাকে দিয়ে ফোন করিয়ে ভিডিও মুছে ফেলার জন্য চাপ দেবার অভিযোগ অস্বীকার করে আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ আলম বেনারকে বলেন, “এমন কিছুই ঘটেনি।”
তিনি বলেন, “সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের (আসাদের স্বজনদের) ডেকে আনা হয়েছিল। তাঁদের সাথে আসাদুজ্জামান নূরের শেষ দেখা-সাক্ষাত কবে হয়েছে, সে এখন কোথায় আছে, মূলত এইগুলো জানতে চেয়েছি।”
“তাঁরা কোনো অপরাধ করেনি। তাঁদের থানায় আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই। তিনি (আসাদ) ‘প্যানিক’ তৈরি করার জন্য বিভিন্ন মনগড়া কথা বলছেন,” বলেন ওসি শাহ আলম।
আসাদ জানান, পরিবারের সদস্যদের আবারও এভাবে উঠিয়ে নেওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তাঁরা।
এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারকে ব্লগার আসাদ নুরের বাবা-মাকে হয়রানি ও ভয় দেখানো বন্ধ করতে হবে। ছেলের মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকাণ্ডের কারণে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন তাঁরা।”
“মানবাধিকার রক্ষাকারীদের অবশ্যই নির্ভয়ে কাজ করতে দিতে হবে,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের একটি মামলায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আসাদ নূরকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরের বছর আগস্টে তিনি জামিনে মুক্তি পেলেও ইসলামি দলগুলো তাঁর জামিনের বিরোধিতায় বিক্ষোভ করে।
পরবর্তীতে তাঁকে অন্য একটি মামলায় আবার আটক করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে দেশের বাইরে চলে যান।
তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তাঁর বর্তমান অবস্থান জানাতে অস্বীকার করেছেন আসাদ নূর।
কী হয়েছিল রাঙ্গুনিয়ায়?
রাঙ্গুনিয়ার পাদুয়া ইউনিয়নের ফলহারিয়া গ্রামের ‘জ্ঞানশরণ মহারণ্য’ বৌদ্ধ বিহারে ৫ জুলাই বুদ্ধের নতুন একটি মূর্তি তৈরির কাজ শুরু করেন সেখানকার ধর্মগুরু, ‘ধুতাঙ্গ সাধক’ শরণংকর থেরোর অনুসারীরা।
খবর পেয়ে গত ৮ জুলাই পুলিশ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয় বন বিভাগ।
পুলিশের অভিযোগ, কাজ বন্ধ করতে বলার পর পুলিশের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন শরণংকর। পরে তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা প্রচণ্ড মারমুখী হয়ে উঠেন।
“পরে এই ঘটনায় রাঙ্গুনিয়া থানায় মামলা দায়ের করেছে বন বিভাগ। শরণংকর থেরো সেই মামলার অন্যতম আসামি,” বেনারকে বলেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম।
এছাড়া সংরক্ষিত বনভূমিতে বন বিভাগের রোপণ করা চারাগাছ কেটে ফেলার অভিযোগে চলতি বছরের ১০ জুন এবং গত বছরের ৩০ অক্টোবরে আরো দুটি মামলা করেছিল বন বিভাগ। যেগুলোর তদন্ত এখনও শেষ হয়নি বলে জানান ওসি।
শরণংকরের প্রধান সহচর জ্ঞানংকর ভিক্ষুর দাবি, বন বিভাগ ও পুলিশ কর্মকর্তারা মিথ্যাচার করছেন।
“স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল দীর্ঘদিন থেকেই বিহারটি উচ্ছেদের চেষ্টা চালাচ্ছে,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন জ্ঞানংকর।
এর আগে ৯ জুলাই রাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১৪ মিনিটের একটি ভিডিও প্রকাশ করে শরণংকর প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন।
পরে ১১ জুলাই রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রাসেল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা এক মামলায় অভিযোগ করেন, শরণংকরের অনুসারীরা দুটি ফেসবুক একাউন্ট থেকে ইসলাম ধর্ম, ধর্মের প্রবর্তক এবং সরকারের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছেন।
ইউটিউব এবং ফেসবুকে এই ঘটনার বিশ্লেষণ করে একাধিক ভিডিও প্রকাশ করেন আসাদ নূর। যেখানে তিনি দাবি করেন, রাঙ্গুনিয়ায় বৌদ্ধদের তাড়ানোর উদ্দেশ্যে চক্রান্ত সাজানো হচ্ছে।
এরপরই আসাদের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ তুলে গত ১৪ জুলাই স্থানীয় থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিমুল দাশগুপ্ত।
এজাহারে বলা হয়েছে, আসাদ নূর ইসলাম ধর্ম, মুসলমান ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে আপত্তিকর ও স্পর্শকাতর মন্তব্য করে উস্কানি দিয়েছেন।
আমতলীর ওসি বলেন, “ওই মামলার প্রেক্ষিতেই রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ আমাদেরকে আসাদের নাম-ঠিকানা যাচাই ও গ্রেপ্তারের অনুরোধ করে। যে কারণে আমরা তাঁর পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করি।”
“তাঁকে পেলে অবশ্যই আমরা গ্রেপ্তার করতাম,” বলেন ওসি।
পালিয়ে আছেন শরণংকর
জ্ঞানংকর ভিক্ষু বেনারকে বলেন, “ওই ঘটনার পরপরই শরণংকর থেরো এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কবে তিনি বিহারে ফিরে যেতে পারবেন, সে ব্যাপারে কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি এখনও।”
বিহারের সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, সেখানকার বিদুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
আসাদ নূর জানান, তাঁর এবং শরণংকর থেরোর বিরুদ্ধে ওই এলাকায় ইতিমধ্যে ২৫-৩০টা মানববন্ধন হয়েছে। যেখান থেকে তাঁদের হত্যা করার মতো হুমকিও প্রকাশ্যে দেওয়া হয়েছে।
তবে ওসি সাইফুল বলেন, “ফলহারিয়া গ্রামে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।”
এই ঘটনার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন বৌদ্ধধর্মালম্বীরা।
তবে রাঙ্গুনিয়ার ফলহারিয়ায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সেখানকার প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধি বৌদ্ধ নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির ঢাকা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক স্বপন বড়ুয়া চৌধুরী।