প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.09.19
ঢাকা
180919_Digital_Security_law_1000.jpg জাতীয় সংসদে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
সৌজন্যে: বাসস

জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিরোধী অভিহিত করে তা বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ সভা করেছে বিরোধী দল সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।

একইভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এবং মানবাধিকার কর্মীরা ব্রিটিশ আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ এর বিধানসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের বিরোধিতা করেছেন।

তাঁদের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ায় সাংবাদিকেরা ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ প্রয়োগ করবে। আইনটির কারণে সাংবিধানে দেওয়া মত প্রকাশ বা চিন্তার স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে।

আইনটি পাস হওয়ার পর সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বেনারকে বলেন, “স্বাধীন সাংবাদিকতা, মত প্রকাশ ও গণতন্ত্রের জন্য একটি দুঃখজনক দিন। এর বাইরে আর কিছু বলতে চাই না।”

জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ এর আগে আইনটি প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেয়।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা শওকত মাহমুদ বেনারকে বলেন, “যে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে সেই আইন অনুযায়ী সরকারি কোনো ভবনের স্কেচ করলেও আপনি সরকারের গোপনীয়তা ভঙ্গ করবেন। তাহলে সাংবাদিকতা বা মুক্তচিন্তা থাকবে কীভাবে?”

তাঁর মতে, এই আইন পাশ হলে যেকোনো পুলিশ অফিসার চাইলেই কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দিতে পারবে। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, আমার দেশ পত্রিকা পুলিশের একজন এসআই ৫৭ ধারায় অভিযোগ এনে বন্ধ করে দিয়েছে। আজও সেটি চালু হয়নি।

শওকত মাহমুদ বলেন, সরকার ৫৭ ধারা বাতিল করছে। কিন্তু ৫৭ ধারার সকল বিধান নতুন আইনের বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারার চেয়ে আরও কঠোর বিধান আছে।

“বিরোধী মত দমনই এই আইন পাশের মূল লক্ষ্য,” মন্তব্য করে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির এই নেতা বলেন, “যারাই সরকারের বিরোধিতা করবেন তাঁদেরকেই বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর বলে তকমা দেওয়া হবে।”

বুধবার রাতে সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হয়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কিছু সদস্য বিলের বিরোধিতা করেন ও বিলের কিছু সংশোধনী আনেন। তবে তাঁদের সংশোধনীগুলো বাতিল হয়ে যায়।

বিরোধী দলের একাধিক সদস্য গতকাল এই আইনের সমালোচনা করে বলেছেন, আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ১১ জন ও একজন স্বতন্ত্র সাংসদ বিলটি নিয়ে জনমত যাচাই এবং আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রস্তাব দেন।

তবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এই আইনটিকে ‘ঐতিহাসিক আইন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

আইনে পুলিশকে পরোয়ানা এবং কারও অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

বিরোধী দলের সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, অংশীজনদের আপত্তি ও বিতর্কিত ধারাগুলো অপরিবর্তিত রেখে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা খুবই উদ্বেগজনক।

ফখরুল ইমাম আরও বলেন, এর ফলে অনুসন্ধানীমূলক সাংবাদিকতা ও গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।

বিরোধী দলের সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এই আইনে সংবাদে কাঁচি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই একজন কর্মকর্তা কোনো সংবাদ ব্লক বা অপসারণ করতে পারবেন।

‘সরকারি অফিসের সবকিছু কি ওপেন?’

তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বেনারকে বলেন, সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের মাধ্যমে ২০০৬ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ মোট পাঁচটি ধারা বাতিল করেছে।

তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনোভাবেই মত প্রকাশের বা সাংবাদিকদের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে না।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অফিশিয়াল সিক্রেসি (সিক্রেটস) অ্যাক্ট দেশের একটি বৈধ আইন। এই আইনটি কি আমরা ব্যবহার করতে পারি না? আপনারা অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের বিরুদ্ধে বলেন। আমার সরকারি অফিসের সবকিছু কি ওপেন? আমাদের গোপন কিছু থাকবে না?”

সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে সাংবাদিকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল।

তিনি বেনারকে বলেন, “ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে থাকলে সাংবাদিকেরা সেলফ সেন্সরশিপ প্রয়োগ করবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা সাংবাদিকেরা স্থায়ী কামিটির সভায় বলেছিলাম, কোনো প্রকার ঘটনা ঘটলে প্রেস কাউন্সিল সেটি প্রাথমিক তদন্ত শেষে জানাবে যে ঘটনাটি কি ডিজিটাল অপরাধ কি না। কিন্তু সেটি রাখা হয়নি।”

বেসরকারি একুশে টেলিভিশনের এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “তথ্য প্রযুক্তি আইন পাশ হওয়ার সময় আমাদের বলা হয়েছিল যে এই আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ব্যাপক অপপ্রয়োগ হয়েছে।”

“তথ্য অধিকার আইনের সাথে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সাংঘর্ষিক,” বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, তারা বিলটি চূড়ান্ত করার আগে আমাদের সাথে আবার বসবেন। কিন্তু তারা তা না করেই বিলটি চূড়ান্ত করে ফেললেন। এটা ঠিক হলো না।”

সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে

মানবাধিকার আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধুমাত্র সাংবাদিক বা সাংবাদিকতাকে হুমকির মধ্যে ফেলবে না। এ দেশের প্রতিটি মানুষের মুক্ত চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করবে, ভিন্ন চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করবে। আমাদের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিককে যে মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছে সেগুলোকে হুমকির মধ্যে ফেলবে।”

তিনি বলেন, “২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন বাংলাদেশের একমাত্র আইন যা সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জনগণকে ক্ষমতায়িত করেছে; বাকি সব আইন জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। অর্থাৎ তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে সরকার কী করছে সে বিষয়ে জনগণকে তথ্য প্রদান করতে সরকারকে বাধ্য করার নিশ্চয়তা দিয়েছে রাষ্ট্র।”

ব্যারিস্টার বড়ুয়া বলেন, কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের কথা বলে সরকারের স্বচ্ছতার পথ বন্ধ করা হচ্ছে, মুক্তচিন্তার পথ বন্ধ করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।