নির্বাচনের আগে গুজব শনাক্তকারী সেল গঠন

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.10.09
ঢাকা
181009_Monitoring_cell_1000.jpg সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে অভিনয়শিল্পী নওশাবা আহমেদকে ৪ আগস্ট গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছবিটি ঢাকা থেকে ২০ আগস্ট তোলা।
বেনারনিউজ

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর ও গুজব প্রচার ঠেকাতে গুজব শনাক্তকারী সেল গঠন করেছে সরকার। এই সেল এ মাসের মধ্যেই কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বলে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের একথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করার একদিন পরই সরকারের পক্ষ থেকে এই তদারকি সেল গঠনের কথা জানানো হলো।

সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটি ১০ লাখ। তাঁরা প্রায় সকলেই ভোটার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকল বয়সের মানুষের উপস্থিতির কারণে নির্বাচনের আগে তা তদারকি করতে যাচ্ছে সরকার।

তাঁদের মতে, একটি গুজব অথবা ভুয়া খবর ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গবেষকদের মতে, গুজব শনাক্তকারী সেল দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ঠেকানো সম্ভব নয়।

তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজব শনাক্ত করতে নয় সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এই মনিটরিং সেল এই মাসেই গুজব শনাক্ত করা শুরু করবে।”

তিনি বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুর রহমান এই কমিটির প্রধান।

তারানা হালিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সেলের সদস্য ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের প্রতিনিধি, পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, বিটিআরসিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

তারানা হালিম বলেন, “কোনো এলাকায় কোনো গুজব ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া গেলে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হবে এবং তাঁরা পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়কে ওই গুজব সম্পর্কে তথ্য দেবেন।”

তিনি আরও বলেন, “তথ্য যাচাই করতে গোয়েন্দাদের কাছ থেকেও তথ্য নেওয়া হবে। পরে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিটিআরসি’কে ওইসব পেইজ বন্ধ করার জন্য অনুরোধের পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও জানানো হবে।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “দেশ-বিদেশে প্রায় তিন’শ পেজ ব্যবহার করে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এসব প্রচারণায় নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এই সেলের কাজ হচ্ছে কোনটি গুজব সেটা শনাক্ত করে মিডিয়াকে অবহিত করা যে এটি গুজব। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মিথ্যা বা অসত্য বা বানোয়াট তথ্য বা অতিরঞ্জন যেটির কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ক্ষুণ্ন হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত এবং রাষ্ট্র বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় সেগুলো চিহ্নিত করা।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো গুজব ঠেকাতে গঠিত গুজব শনাক্তকারী সেল গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একসেস টু ইনফরমেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে গুজব বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করবে।

এরপর এই সেলের উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করিয়ে ঘটনার বা তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হবে।

যদি বিষয়টি গুজব হয়, সেলের পক্ষ থেকে তা দ্রুত মূলধারার গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

তারানা হালিম বলেন, তাঁরা শুধু গুজব শনাক্ত করে তা দ্রুত জানিয়ে দেবেন; কোনো ‘পুলিশিং’ করবেন না। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ঐক্যবদ্ধভাবেই এই কাজ করবে। গুরুত্ব বিবেচনায় দৈনিক বা সপ্তাহে গুজব শনাক্ত করে জানানো হবে।

অন্যদিকে পুলিশও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে কাজ করছে।

পুলিশের প্রায় ১০০ ইউনিটকে এই কাজে যুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, অনলাইন মাধ্যমে ‘জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি’ এমন যেকোনো বিষয়কে নজরদারির আওতায় আনতে কাজ চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “নির্বাচনের সময় তারা যেন কোনো প্রকার গুজবের শিকার না হয়—এই চিন্তা থেকে সরকার নির্বাচনের আগে গুজব শনাক্তকারী সেল গঠন করে থাকতে পারে।”

তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সাইবার অপরাধীদের বিচার করা যাবে সেটা ঠিক। কিন্তু যদি কেউ কোনো গুজব প্রচার করে কোনো দাঙ্গা ঘটিয়ে ফেলে তার ফলাফল সরকারের জন্য মারাত্নক হতে পারে। তারা হয়তো এধরনের কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না।”

ড. শান্তনু বলেন, “বিরোধীদল বলছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ ও গুজব শনাক্তকারী সেল গঠনের উদ্দেশ্য হলো বিরোধীদল ও বিরুদ্ধ মত দমন করা। সরকারে সেই ইচ্ছা থাকতে পারে। তবে সেটা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা দরকার।”

তিনি বলেন, “তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রচারের ফলাফল কী হতে পারে তা আমরা দেখছি। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজবকে কেন্দ্র করে পুরো উত্তরাঞ্চল উত্তাল হয়ে গিয়েছিল। রামুতে ইসলাম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে বৌদ্ধদের মন্দির পোড়ানো হয়েছে। নাসিরনগরে ও রংপুরে একইভাবে হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে।”

তাঁর মতে, “সুতরাং গুজব ঠেকানোর সেল প্রয়োজন। তবে সেটা যেন কোনভাবেই বিরোধীদল ও চিন্তার স্বাধীনতাকে দমন করতে ব্যবহার করা না হয়।”

তথ্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গবেষক আবু সাঈদ খান বেনারকে বলেন, “অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমানে চীন চেষ্টা করছে গুজব ও ভুয়া খবর বন্ধ করতে। তারাও পারছে না। আমি মনে করি না গুজব অথবা ভুয়া খবর বন্ধ করা সম্ভব।”

তিনি বলেন, গুজব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও আরো অসংখ্য। আপনি কতটা তদারকি করবেন?” তিনি মনে করেন, “এই সেল সফল হবে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।