আসামে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ ১৯ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হবে ট্রাইব্যুনালে

পরিতোষ পাল
2019.09.03
কলকাতা
190903_NRC_FINAL_LIST_1000.jpg কলকাতায় আসাম ভবনের সামনে নাগরিকপঞ্জি বিরোধী মুক্ত মঞ্চের প্রতিবাদ সভা। ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হবে আধা বিচারিক ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। তালিকায় নাম তোলার জন্য বারবার আবেদন করেও ব্যর্থ এসব মানুষকে প্রমাণ করতে হবে যে, তাঁরা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক।

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা এক হাজারে উন্নীত করার কথা জানিয়েছেন। সাংবাদিকদের বলেছেন, বিদ্যমান একশ ট্রাইব্যুনালের সাথে সোমবার থেকে দুইশ নতুন ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করেছে।

তবে ট্রাইব্যুনালে গিয়েও বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্লেষকেরা।

“ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মানুষ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে তাতে নতুন করে সেখান থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা নেই বললেই চলে,” বেনারকে বলেন আসামের বিশিষ্ট আইনজীবী ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হাফিজ রশিদ চৌধুরী।

“আর লাখ লাখ মানুষের আবেদন পর্যালোচনা করার মতো সময় এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত গঠন করা হয়নি,” বলেন তিনি।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ৩১ আগস্ট থেকে ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানাতে হবে। সেখানেও নাগরিকত্ব আদায় না হলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া যাবে।

এই দীর্ঘ ও ব্যয় বহুল জটিল আইনি প্রক্রিয়ায় কতজন মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আসামের নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ।

তিনি বেনারকে বলেন, “১৯৯৭ সালে ট্রাইব্যুনাল পৌনে চার লাখ মানুষকে সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখে। কিন্তু ২২ বছরেও সেগুলির নিষ্পত্তি করতে পারেনি। সেখানে মাত্র ১২০ দিনে আরও কয়েক লাখ মানুষের আবেদনের নিষ্পত্তি ঘটানো অসম্ভব।”

ফলে ৫-৭ লাখের বেশি মানুষ ট্রাইব্যুনালে যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

গুয়াহাটির বাসিন্দা নরোত্তম দাস বেনারকে বলেন, “সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আমার নাম ওঠেনি। এখন ট্রাইব্যুনালের দরজায় দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। তবে উচ্চ আদালতে যাওয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই।”

সরকার অবশ্য জানিয়েছে, সব রকম আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এনআরসি প্রক্রিয়ার ফলে কেউ যাতে রাষ্ট্রহীন না হন, তা নিশ্চিত করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন।

রোববার জেনেভা থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বিশাল সংখ্যক মানুষকে কোনো প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন মানুষ দূরীকরণ উদ্যোগে বড় আঘাত হানবে।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া এক বিবৃতিতে ট্রাইব্যুনালগুলি যাতে স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে বর্ণিত নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করে সেই ব্যবস্থা করার আবেদন জানিয়েছে।

অ্যামনেস্টির ভারতীয় শাখার প্রধান আকর প্যাটেল বলেন, “ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে একতরফা, পক্ষপাতদুষ্ট ও বৈষম্যমূলক রায় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।”

এখনই আটক নয়

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র সোমবার এক টুইট বার্তায় জানান, আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া কাউকে কোনো অবস্থাতেই আটক করা হবে না। আগের মতোই সমস্ত নাগরিক অধিকার, এমনকি চাকরি, শিক্ষা ও তাঁদের সম্পত্তির অধিকারও বহাল থাকবে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনার পর গত শনিবার আসামের এই জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়।

গত বছরের ৩০ জুলাই প্রকাশিত খসড়া তালিকায় ৪২ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়লেও চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়ে ১৯ লাখ। এর মধ্যে চার লক্ষ মানুষ খসড়া থেকে নাম বাদ পড়ার পরও নাগরিকত্ব পুনর্বিবেচনার আবেদন করেননি।

নাখোশ সব পক্ষই

আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে সর্বস্তরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এই নাগরিকপঞ্জি তৈরিতে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ভারতীয় জনতা পার্টিই এই তালিকা দেখে হতাশ হয়েছে।

আসাম রাজ্য বিজেপির সভাপতি রঞ্জিত দাস বলেন, “আমরা তালিকা দেখে হতাশ হয়েছি। বহু হিন্দুর নাম তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে। রয়েছে বিদেশিদের নাম।”

তিনি বলেন, “আমাদের রাজ্য কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এনআরসির তালিকা থেকে বাদ পড়া আসামের ভূমিপুত্রদের রক্ষা করার জন্য আইন প্রণয়ন বা ভারতের সংবিধানে সংশোধনী আনার জন্য ভারত সরকার এবং বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির কাছে আমরা আবেদন জানাব।”

যাদের দীর্ঘ আন্দোলনের পরিণতিতে বিদেশি বাছাইয়ের জন্য এই প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই অল আসাম ছাত্র ইউনিয়নের (আসু) মুখ্য উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, “এই তালিকা আমাদের হতাশ করেছে।”

“কারণ, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময়ে রাজ্যে যত বিদেশির উপস্থিতির কথা বলে এসেছে, এই তালিকা তার ধারে কাছেও নেই। প্রতিকার চেয়ে আমরা সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হব,” বলেন তিনি।

কংগ্রেস মুখপাত্র অভিজিৎ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “এনআরসিতে বেশির ভাগ বাঙালির ওপরে কোপ পড়েছে। তার উপরে বর্তমান সরকার অসম চুক্তির ৬ নম্বর দফা রূপায়ণে কমিটি গড়েছে। সেই শর্ত রূপায়ণ হলে বাঙালিরা সম্পত্তি ও ভোটে দাঁড়ানোর অধিকারও হারাবে।”

বহু নাম বাদ পড়েছে তুচ্ছ কারণে

“বানান ভুল, পিতার নামের সঙ্গে সামান্য পার্থক্য, বয়সের ভুলকে অজুহাত দেখিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হাজার হাজার মানুষের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে” অভিযোগ করেন করেন অল আসাম ইয়ুথ স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট ভাওয়াল।

শেষ পর্যন্ত নিজের ও পরিবারের সকলের নাম উঠলেও তাঁর কাকার নাম বাদ পড়েছে।

তিনি বেনারকে বলেন, “সুনির্দিষ্ট প্রামাণ্য নথি হিসেবে শরণার্থী সনদ ও অভিবাসী সনদকেও এনআরসি আমলে নেয়নি। রেলওয়ের সাবেক কর্মীরা পেনশনের নথি দেখানো সত্ত্বেও বলা হয় অ্যাপয়নমেন্ট লেটার দিতে হবে।”

পশ্চিমবঙ্গেও ক্ষোভ

আসামের এনআরসি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশের মানুষের রাষ্ট্রচ্যুত হওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্র বেনারকে বলেন “ওপার বাংলা থেকে যারা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন কিংবা অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন তাঁদের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তাই ভারত সরকারের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করতে হবে।”

বিজেপির নেতারা পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চালুর দাবিতে সরব হলেও বুধবার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শোভন দেব চট্টোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চালুর দাবি কোনোভাবে মানা যায় না।”

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীর পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী ‘নো এনআরসি টু বেঙ্গল’ নিয়ে আলোচনার দাবি জানিয়েছেন।

আগামী শনি ও রবিবার তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ব্লকে ব্লকে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করবে। ১২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক মিছিলও।

সোমবার কলকাতায় আসাম ভবনের সামনে নাম বাদ পড়া মানুষদের দ্রুত নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে বিক্ষোভ দেখায় নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ। আসাম সরকারের ট্রেড অ্যাডভাইসার ও ডিরেকটর অব মুভমেনট-এর কাছে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্মারক লিপিও দেয়া হয়।

বাংলাদেশের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার

আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি বাংলাদেশ। যদিও বিচ্ছিন্ন বক্তব্যে সরকারের মন্ত্রীরা জানিয়েছেন বাংলাদেশে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সতর্কতাস্বরূপ আসামের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে বলে গেছেন, এনআরসি তাঁদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, এটা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হবে না।”

তবে আসাম পরিস্থিতি বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, “প্রতিটি দেশই নিজেদের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার রাখে। আমরাও নিরাপত্তা জোরদার করেছি।”

আসামের সীমান্ত সংলগ্ন সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে ৫৭টি বিওপির জওয়ানরা সতর্ক রয়েছেন বলে বেনারকে জানান বিজিবি সিলেট সেক্টরের অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন) মিসবাহ উদ্দিন রাসেল।

প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।