অমুসলিমদের প্রাধান্য দিয়ে ভারতে নাগরিকত্ব বিল, কড়া সমালোচনা

পরিতোষ পাল
2019.12.10
কলকাতা
191210_WB_Cab_1000.jpg ভারতের এলাহাবাদে সমাজবাদী পার্টির নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বিরোধী বিক্ষোভ। ১০ ডিসেম্বর ২০১৯।
[এএফপি]

ভারতের লোকসভায় পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) নিয়ে দেশটির ভেতরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। সমালোচিত হচ্ছে বাংলাদেশেও।

বিলটি নিয়ে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ধর্মীয় বিভাজন এবং সংবিধানে বর্ণিত সকলের সমানাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে। এটি সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষ চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে।

সোমবার মধ্যরাতে ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হয়। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবেশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আসা শুধুমাত্র অমুসলিমদেরই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। লোকসভায় দীর্ঘ ১২ ঘন্টা প্রবল বিতর্কের শেষে বিলটি ৩১১-৮০ ভোটে পাশ হয়।

আগামী বুধবার বিলটি সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করা হবে। সেখানে পাশ হলে বিলটি আইনে পরিণত হবে। এই বিলে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনা হয়। আগে অন্তত ১১ বছর ভারতে না থাকলে নাগরিকত্ব দেওয়া হতো না। এবার তা পাঁচ বছর করা হয়েছে।

বিল নিয়ে বিতর্কের উত্তরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, “এই আইনের সঙ্গে এ দেশের মুসলিমদের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই আইন পাশ হলে দেশের মুসলিম সমাজের কোনও সমস্যা হবে না।”

তবে সারা দেশে এনআরসি চালু করা হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।

মুসলিম নেতারা মনে করেন, এই বিল আসলে আরেকটি ভাগাভাগির নজির তৈরি করতে চলেছে।

দেশভাগের কথা মনে করিয়ে দিয়ে অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের সভাপতি আসাদুদ্দিন ওয়াইসি লোকসভায় বিতর্কে অংশ নিয়ে বলেন, “এই বিলের ফলে আরেকটি পার্টিশন হতে চলেছে।”

মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দার মঙ্গলবার বলেন, সংসদে যদি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি পাশ হয় তবে তিনি নিজেকে আইনিভাবে মুসলমান বলে ঘোষণা করবেন।

তাঁর মতে, “ক্যাবের মাধ্যমে অন্য সম্প্রদায়কে সুরক্ষিত করে বিজেপি মুসলিমদের দিকে লক্ষ্য রেখে এনআরসি চালু করতে চাইছে।”

মার্কিন কমিশনের বিবৃতিতে অস্বস্তিতে ভারত

এদিকে ধর্মীয় মানদণ্ড বেঁধে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব বিল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)। সোমবার এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, নাগরিকত্ব দিতে ওই বিলে যে মানদণ্ড বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা খুবই বিপজ্জনক। তারা জানায়, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যে বিল সংসদে পেশ করেছেন, তাতে ধর্মীয় মানদণ্ড বেঁধে দেওয়ায় ইউএসসিআইআরএফ উদ্বিগ্ন।

বিলটি আইনে পরিণত হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সে দেশের শীর্ষ নেতাদের ওপর মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত বলে মত দেন তারা।

এর প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রাবীশ কুমার টুইটারে লিখেছেন, “ইউএসসিআইআরএফ-র দাবি সম্পূর্ণ ভুল ও পক্ষপাতদুষ্ট। বিষয়টি সম্পর্কে ভালোমতো ওয়াকিবহালও নয় ওরা। এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপেরও অধিকার নেই ওদের।”

কলকাতায় এনআরসি বিরোধী যুক্তমঞ্চের মিছিল। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯।
কলকাতায় এনআরসি বিরোধী যুক্তমঞ্চের মিছিল। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ

সোমবার সংসদে পাশ হওয়া ক্যাব বিলটি আসলে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) অন্য পিঠ বলে মন্তব্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার রাজ্যের খড়গপুরে এক জনসভায় তিনি বলেন, “ক্যাব বলুন আর এনআরসি বলুন, একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।”

সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ কামরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “ভারতের মুসলমানদের বেনাগরিক করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে সরকার। মুসলিমরা ভূমিপুত্র হওয়া সত্বেও রাষ্ট্র তাঁদের রাষ্ট্রহীন করার জন্য আইন করছে। আর ক্যাব হলো এনআরসিরই প্রাথমিক ধাপ।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “এই বিলের মাধ্যমে হিন্দত্ববাদী বিজেপি তাদের মূল পরিচিতিকে কার্যকর করতে চাইল। কোন ধাঁচে ভারত চালিত হবে তারই প্রতিফলন ঘটছে বিজেপি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে। এই বিলও তারই অঙ্গ।”

দেশের বামপন্থী সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ কানহাইয়া কুমার, কবিতা কৃষ্ণন, কান্নন গোপীনাথন কলকাতায় সোমবার এক সমাবেশ থেকে এনআরসি, জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি (এনপিআর) এবং ক্যাব ঠেকাতে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার ডাক দিয়েছেন।

প্রতিবাদে ফুঁসছে উত্তর-পূর্ব ভারত

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির মানুষের একাংশ রীতিমত ফুঁসছে।

বিলে অবশ্য ইনার লাইন পারমিট চালু রয়েছে যেসব রাজ্যে সেই সব রাজ্য এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলে বর্ণিত সমস্ত আদিবাসী এলাকাকে আওতার বাইরে রাখা হয়েছে বলে অমিত শাহ জানান। এমনকি মণিপুরেও আগামী দিনে ইনার লাইন পারমিট চালু করে ক্যাবের আওতার বাইরে রাখা হবে বলে আশ্বাস দেন।

কিন্তু অসম ছাত্র সংগঠন (আসু) নেতারা মনে করেন, এই বিল অসমে মোগল আক্রমণের মতোই বিপজ্জনক। গত কয়েকদিন ধরেই আসামসহ এই অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ছাত্রদের আন্দোলন চলছে।

নর্থ-ইস্ট স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের (নেসো) চেয়ারম্যান স্যামুয়েল জাইরা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, “এই বিল অবৈধ বাংলাদেশিদের স্রোতের মতো আসার সুযোগ করে দেবে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের দাবিকেই অস্বীকার করছে।”

মঙ্গলবার আসু ও নেসোর ডাকে আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে হরতাল পালিত হয়। আসামে টায়ারে আগুন লাগিয়ে ও বিভিন্ন জাতীয় সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানানো হয়।

শোনিতপুর ও লখিমপুর জেলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিপুরায় মঙ্গলবার দুপুর থেকে ৪৮ ঘন্টার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেবার ঘোষণা দেওয়া হয়।

আসামের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহ্নু বড়ুয়া ক্যাবের প্রতিবাদে আসাম চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ছবি প্রদর্শনের জন্য দেবেন না বলে ঘোষণা দেন।

বাংলাদেশেও ক্ষোভ

ভারতের লোকসভায় পাশ হওয়া বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানো হলেও বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এই আইন পাশ হলে দুদেশের সম্পর্কে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বেনারকে বলেন, “ভারতের এই নাগরিকত্ব বিল নিয়ে এখনো আমরা কোনো আলোচনা করিনি। তবে এটা নিয়ে খোদ ভারতের মধ্যেই সমালোচনা হচ্ছে। দেখা যাক কী ঘটে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনটি ভারতের সংবিধান পরিপন্থী।

“দেশটির সংবিধানে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে—ধর্মীয়ভাবে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। কিন্তু মেজরিটি থাকার কারণে মোদী সরকার সেটা করেছে। এর মধ্যে দিয়ে বহির্বিশ্বে ভারতের ‘অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক’ইমেজ ভুলণ্ঠিত হলো,” তিনি বলেন।

“ভারত ধীরে ধীরে একটি হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাস করা যার প্রথম পদক্ষেপ,” বলেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

প্রতিবেশি দেশের এই বৈষম্যমূলক আইন বাংলাদেশে কী প্রভাব ফেলবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. তারেক বলেন, “মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে অনেক মুসলমান আছে যারা এসব বিষয়ে খুব সেন্সেটিভ।”

“ফলে একটি গোষ্ঠী তাদেরকে সংগঠিত করে সরকার ও ভারতবিরোধী জনমত গড়ে তুলতে পারে। যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য ভালো খবর বয়ে আনবে না,” মনে করেন তারেক শামসুর রেহমান।

ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।