বাংলাদেশের দুই মন্ত্রীর ভারত সফর বাতিলের ঘোষণা
2019.12.12
ঢাকা ও কলকাতা

ভারতের রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার একদিন পরই ভারত সফর বাতিল করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বৃহস্পতিবার কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দুই মন্ত্রীর সফর বাতিলের ঘোষণা আসে। ধারণা করা হচ্ছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়া নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে।
এদিকে বুধবার আসাম রাজ্যের গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনারের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত গাড়িতে হামলা হয়েছে।
ষষ্ঠ ইন্ডিয়ান ওশান ডায়ালগে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়াদিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার সকালে মেঘালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর বাতিলের কারণ সম্পর্কে মন্তব্য করেননি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “অনিবার্য কারণে বৃহস্পতিবার বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পূর্বনির্ধারিত সফর বাতিল হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ। তিনি বলেন, “মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে শুক্রবার ওই রাজ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর করার কথা ছিল। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর বাতিল করা হয়েছে।”
শরীফ মাহমুদ বেনারনিউজকে বলেন, সুবিধাজনক সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফর করবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বাতিলের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। যদিও গত বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারের সঙ্গে নিজ দপ্তরে বৈঠক শেষে আব্দুল মোমেন খোলাখুলিভাবে সাংবাদিকদের কাছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে অস্বস্তির কথা জানান।
“ভারত ঐতিহাসিকভাবে একটি সহনশীল দেশ, যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। সেখান থেকে পদস্খলন হলে ভারতের ঐতিহাসিক অবস্থান দুর্বল হবে,” নিজ দপ্তরে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন আব্দুল মোমেন। তিনি আরও বলেন, বিলটি উত্থাপনের সময় বেশ কিছু কথা উঠেছে যার অনেকগুলো সত্য নয়।
উদাহরণ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশে অন্য ধর্মের মানুষ নিপীড়িত নয়। বাংলাদেশের সব নাগরিককে এক দৃষ্টিতে দেখা হয়। কে কোন ধর্মের বিচার করা হয় না।
“যেটা ওনারা তথ্য দিয়েছেন, বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কথাটা সত্য নয়। যাঁরা তথ্য নিয়েছেন, ওনাদের যাঁরা বুঝিয়েছেন, তাঁরা সত্যি কথা বলেননি,” পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগণ আশা করে ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে দু’দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “দুই মন্ত্রী কেন ভারত সফরে বাতিল করেছেন, তা সহজে অনুমান করা যায়। গত এক দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু নাগরিকত্ব ইস্যুর কারণে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। তিনি বলেন, মুসলিমদের বাদ দিয়ে হিন্দু ভোটারদের ঐক্যবদ্ধ করতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি এবং নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বিজেপি এই খেলা খেলতেই থাকবে।"
এদিকে ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার বীণা সিক্রিকে উদ্ধৃত করে আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, “পড়শি দেশে যে অমুসলিমদের ওপর নিপীড়নের ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, তা হয়তো খালেদা জিয়ার আমলে বেশ কিছু রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এখন তা নিয়ে কথা বলে খামোকা দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির তৈরি হচ্ছে। অবিলম্বে তা দূর হওয়া উচিত।”
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে যা আছে
ভারতে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় গত সোমবার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হয়। বুধবার রাজ্যসভায় পাস হয়। বিলটি পাশ হওয়ায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অ-মুসলিম শরণার্থীরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক কমিশন (ইউএসসিআইএরএফ) এক বিবৃতিতে গত সোমবার জানায়, বিলটিতে ধর্মীয় মানদণ্ড বেঁধে দেওয়াটা বিপজ্জনক।
সোমবার লোকসভায় বিলটি উত্থাপন করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলে সেখানে অন্য ধর্মের মানুষরা নিপীড়িত হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন।
নির্বাচনী প্রচারের সময় বিজেপি নেতারা প্রথম জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরি করে দেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর ঘোষণা দেন। সে সময়ই বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এনআরসি প্রসঙ্গ তোলেন। মোদী তাঁকে আশ্বস্তও করেন।
কিন্তু ১ অক্টোবর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের এক জনসভায় দেশজুড়ে এনআরসি করার ঘোষণা দেন। কিছুদিন পর ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকে প্রসঙ্গটি তোলেন। মোদী বলেন, শীর্ষ আদালতের নির্দেশে এনআরসি শুরু হয়েছে।
আসামে চলছে বিক্ষোভ, গুলিতে নিহত ৩
সংসদে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (ক্যাব) বিরুদ্ধে আসামের বিভিন্ন জায়গায় হিংসাত্মক বিক্ষোভ চলছে। কার্ফু অমান্য করে বুধবারের মতোই বৃহষ্পতিবার সকাল থেকে জনতা পথে নেমে আসে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, গুয়াহাটির লালুঙ গাঁও-তে এ দিন বিক্ষোভ মোকাবিলায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। গুরুতর আহত অবস্থায় পাঁচজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তিনজনের মৃত্যু হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর টহল চলছে গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, তিনসুকিয়া ও জোরহাট জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
টুইটারে অসমবাসীর উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অসমিয়া ভাষায় তিনি লিখেছেন, “ক্যাব নিয়ে আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। কেউ আপনাদের অধিকার কাড়তে পারবে না।”
এদিকে আসামের দশ জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার যে ঘোষণা বৃহষ্পতিবার দেওয়া হয়েছিল, তা আরও ৪৮ ঘন্টার জন্য বাড়ানো হয়। এ দিন বেশ কিছু সংস্থা আসাম বিমানবন্দর থেকে তাদের একাধিক বিমানের ফ্লাইট বাতিল করেছে। বাতিল করা হয়েছে বেশ কিছু বিমানের অবতরণ। বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলাচল।
অল আসাম ছাত্র ইউনিয়ন (আসু) এদিন গুয়াহাটির লাটাশীল খেলার মাঠে আয়োজিত এক জনসভা থেকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে বিল প্রত্যাহারের জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এই সভায় ছাত্র-যুব ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন।
আসুর মুখ্য উপদেষ্টা সমুজ্জল ভট্টাচার্য বলেন, সংসদে নাগরিকত্ব বিল পাশ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল আসামের মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
“কেন্দ্রের সরকার আসামের মানুষের প্রতি যে চূড়ান্ত অবিচার করেছে তা আসু কোনভাবেই মেনে নেবে না। যে কোনও মূল্যে জনজাতিদের পরিচিতি ও অস্তিত্ব রক্ষা করা হবে,” সমুজ্জ্বল বলেন।
বাংলাদেশি কূটনীতিকের গাড়িতে হামলা
গত বুধবার আসাম রাজ্যের গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনারের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত গাড়িতে হামলা হয়েছে। এসময় সহকারী হাইকমিশনার গাড়িতে ছিলেন।
এই প্রেক্ষাপটে গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন চত্বর, দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে ভারত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাসকে কেন্দ্র করে গুয়াহাটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনারের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত গাড়িতে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব কামরুল আহসান ঢাকায় তাঁর দপ্তরে ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আলোচনা করেন।
কামরুল আহসান সহকারী হাইকমিশনের সম্পত্তি এবং এর কর্মচারী-কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বাড়াতে রীভা গাঙ্গুলী দাশের কাছে অনুরোধ জানান।