শেখ হাসিনার ভারত সফর: তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে অগ্রগতি
2017.04.10
নয়াদিল্লি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে অর্ধ যুগ ধরে স্থবির হয়ে থাকা পানি বণ্টন চুক্তি বিষয়ে অগ্রগতির একটি লক্ষণ দেখা গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যদিও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়ে দুপক্ষের এখনো ঐক্যমত্যে পৌঁছানো বাকি, তবু শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শীঘ্রই একটি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে একমত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা মোদির অবস্থান সম্পর্কে বলেন “শীঘ্র পানি চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য তিনি আবারো তাঁর সরকারের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। আর এটা যখন হবে, তখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের আরেকটি নতুন দিক উন্মোচিত হবে।”
চারদিন সফরের শেষ দিন সোমবার শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি কেন্দ্রিক এডভোকেসি সংস্থা ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা চাই যৌথ পানিসম্পদ আমাদের একটি ঐক্যের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত হোক। আমাদের যৌথ ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে যৌথ নদীগুলোতে পানি প্রবাহের ঐতিহ্যগত ধারার পাশাপাশি, অববাহিকা কেন্দ্রিক পানি বণ্টন সমস্যার একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধানের মধ্যেই।”
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম রাজ্যের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশ ২০১১ সালে একটি ঐক্যমত্যে পৌঁছায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে চুক্তিটি পরিত্যাক্ত হয়। মমতার বক্তব্য ছিল এই চুক্তি হলে তাঁর রাজ্যের একটি বড়ো অংশ মরুভূমিতে পরিণত হবে।
ভারতের সিকিমে উৎপন্ন তিস্তা নদীর স্রোত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ২,৭৫০ কিলোমিটার বহমান। প্রায় এক কোটি মানুষের জীবনযাত্রা এই নদীর উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন যে, ভারতে পানি আটকানোর ফলে বাংলাদেশের এক লক্ষ হেক্টরের বেশি জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
“আমি আমাদের প্রতিশ্রুতি ও অব্যাহত প্রচেষ্টার বিষয়ে আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে নিশ্চয়তা দিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, শুধু আমার সরকার এবং আপনার সরকারই তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুজে বের করতে পারবে, এবং তা করবেও,” সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন নরেন্দ্র মোদি।
২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত
শেখ হাসিনার সফরকালে দুই দেশের স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক শক্তি, তথ্য প্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তার মতো বিষয়।
“হাসিনার ভারত সফরকালে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষিরত হওয়াতে প্রমাণ করে যে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুদিন থেকে খুবই উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে,” বেনারকে বলেন নয়াদিল্লি কেন্দ্রিক সেন্টার ফর পলিসির বিশ্লেষক ভারত কার্নাড।
“কিন্তু বিষয়টা এমন নয় যে মমতা বন্দোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তি চান না। তিনি এটা চান, তবে চুক্তি আটকে দিয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মোদির ওপর প্রভাব খাটিয়ে কিছু দাবি দাওয়া আদায় করতে চান। এই চুক্তির জন্য রাজি করাতে মোদি তাঁকে কতটা ছাড় দেন তা তিনি দেখতে চান,” বেনারকে বলেন কার্নাড।
এদিকে শনিবার শেখ হাসিনার সাথে সভায় মমতা তিস্তার পানি ভাগাভাগি হলে তাঁর রাজ্য সমস্যায় পড়বে জানিয়ে তিস্তার পরিবর্তে তোরসা নদীর পানি বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছেন।
তবে ঢাকার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদীর বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়েছে।
“অবশেষে পানি বণ্টন বিষয়ে মমতা তাঁর সুর নরম করেছেন। এটা একটা আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি এবং হাসিনার সফরের বড়ো অর্জন,” বেনারকে বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিষয় বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় হাজারিকা।
তবে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ তিস্তা চুক্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য মমতার কঠোর সমালোচনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল হয়েছে। তবে তিস্তার পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে খেলাটা খেলছেন তা দুঃখজনক।”
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমানের মতে, চুক্তিগুলো থেকে ভারতই বরং বেশি লাভবান হয়েছে।
তিনি বেনারকে বলেন, “তুলনামূলকভাবে আমরা যা চেয়েছিলাম তা পাইনি। এটা নিশ্চিতভাবে জনগণকে হতাশ করবে।”
“আমাদের প্রত্যাশা ছিল, বাণিজ্য বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে, কিন্তু সেখানে আমরা কোনো অগ্রগতি দেখিনি। অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার বিষয়েও ভারত কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি,” বেনারকে বলেন তারেক শামসুর রহমান।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন নয়াদিল্লি থেকে আকাশ বশিষ্ঠ, গৌহাটি থেকে ঝুমুর দেব ও ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি