বিএসএফের গুলিতে স্কুলছাত্রের দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কা

প্রাপ্তি রহমান
2018.05.18
ঢাকা
কুড়িগ্রামে বিএসএফ এর গুলিতে আহত কিশোর রাসেল মিয়া। কুড়িগ্রামে বিএসএফ এর গুলিতে আহত কিশোর রাসেল মিয়া। ১৭ মে ২০১৮।
বেনারনিউজ

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে আহত কিশোর মো. রাসেল মিয়া (১৪) দৃষ্টি শক্তি হারাতে বসেছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, রাসেল ডান চোখে কিছু দেখছে না, বাম চোখের অবস্থাও খারাপ।

গত ৩০ এপ্রিল কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার নাওডাঙা ইউনিয়নের বালাতাড়ি গ্রামে বিএসএফের গুলিতে নবম শ্রেণির ছাত্র রাসেল আহত হয়। ফুলবাড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রথমে তাকে রংপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। গত ৫ মে থেকে রাসেল ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছে।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, রাসেলের দুই চোখে প্রচুর স্প্লিন্টার রয়েছে।

“রাসেল ডান চোখে কিছু দেখছে না। আলো ফেললে বুঝতে পারে কিন্তু আলোটা কোন দিক থেকে আসছে তা বুঝতে পারে না। স্প্লিন্টার তার অক্ষিগোলকে ঢুকে গেছে। অক্ষিগোলকের বাইরে থাকলে অস্ত্রোপচারে অনেক সময় সুফল পাওয়া যায়,” গোলাম মোস্তফা বেনারনিউজকে বলেন।

এই ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার রাসেল মিয়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সহযোগিতায় ভারতীয় দূতাবাসে অভিযোগ জানিয়েছে। এর আগে আসক ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি দেয়। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত আসক চিঠির কোনো জবাব পায়নি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আবু আহমেদ ফায়জুল কবির গতকাল বেনারনিউজকে বলেন, ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এ বিষয়ে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিষয়টি ভারতীয় আদালতে উপস্থাপনের কথা রয়েছে চলতি সপ্তাহে। আদালতে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি, রাসেলের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের আবেদন জানানো হবে।

যা ঘটেছিল

গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় চিকিৎসাধীন রাসেলের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র রাসেল মিয়া শবে বরাতের ছুটি থাকায় সেদিন স্কুলে যায়নি। বাবা মো. হানিফউ্দীন বাড়ির কাছেই গরু চরাতে গিয়েছিলেন। চারটে গরু আর তাদের জন্য কেটে রাখা ঘাস নিয়ে একা আসতে কষ্ট হবে বলে ছোট ছেলেকে ডেকে পাঠান তিনি। তখন বিকেল সোয়া ৩টা।

“সীমান্তের কাঁটাতারের ওই পারে ভারতের ভুট্টাখেত, এই পারে ধরলা নদী। তার পাশেই মাঠে ঘাস কাটছিল বাবা। হঠাৎ দেখি বিএসএফ। আমাদের দিক বন্দুক তাক করতেই আমি ধরলা নদীতে ডুব দিই। যেই মাথা জাগিয়েছি তখনি গুলি,” জানায় রাসেল।

“আমি চিৎকার করে বলি, বাবা আমাক গুলি লাইগেছে, বাবা আগান,” রাসেল বেনারনিউজকে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়।

ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে রাসেলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় তারই স্বজনেরা। রাসেলের ভাই রুবেল মিয়া জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে তার এক্সরে প্রতিবেদন দেখান। চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে রুবেল বলেন, তাঁর ভাইয়ের মুখমণ্ডলে ৪০টি স্প্লিন্টার আছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তা গোলাম মোরশেদের সঙ্গে। বিজিবি-১৫ ব্যাটালিয়নের এই অধিনায়ক বলছিলেন, “রাসেল নির্দোষ। এ নিয়ে দুবার পতাকা বৈঠকে বিজিবি প্রতিবাদ জানিয়েছে।”

“ঘটনাটি ঘটার পরদিন কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তখন ভারত দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে কয়েকদিন পর বৈঠকে তারা অভিযোগ অস্বীকার করে। আমরা মৌখিক ও লিখিতভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছি,” গোলাম মোরশেদ বেনারনিউজকে বলেন।

বিএসএফের পক্ষ থেকে ছররা গুলিতে রাসেলের আহত হওয়ার বিষয়ে পতাকা বৈঠকের কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে বিএসএফের উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের কোনো অধিনায়ক এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএস​এফের একটি সূত্র দাবি করেছে, রাসেল চোরাচালান চক্রের সদস্য ছিল। তাদের সতর্ক করার পরও সরছিল না, এরপর ফাঁক গুলি করা হয়।

ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এর উপদেষ্টা কিরীটি রায় বেনারকে বলেন, তাঁরা হাইকোর্টে যাবেন, এ ঘটনার প্রতিকার চাইবেন।

“রাসেলকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। সীমান্তে ছররা গুলির ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এটাকে নিরীহ অস্ত্র বলে দেখানোর চেষ্টা হলেও আসলে এটা মোটেও নিরীহ নয়। এর আগেও এই অস্ত্র ব্যবহার করায় মানুষ পঙ্গু হয়েছে। সাজা হয় না বলেই সীমান্তে এসব ঘটনা ঘটছে,” কিরীটি রায় বলেন।

২০১৭ সালে সীমান্তে ২৪ বাংলাদেশি হত্যা

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানিকে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ফেলানির ওই ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবি সে সময় সীমান্তে বিএসএফের নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

বিজিবির (উত্তরাঞ্চল) একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারনিউজকে বলেন, চোরাচালানির ঘটনা ঘটছে, সীমান্তের এপার-ওপারে যাতায়াতের ব্যাপারও আছে। কিন্তু বিষয়টি একপাক্ষিক না। চোরাচালান করছেন দুই দেশের মানুষ। কিন্তু নিহত হচ্ছেন বাংলাদেশের নাগরিক। আর সবসময় যে চোরাচালানকারীরাই নিহত হচ্ছেন, বিষয়টি তা-ও নয়।

ওই সূত্রের মতে, অনেক দেন দরবারের পর ভারত এখন সীমান্তে প্রাণঘাতি অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার বন্ধ করেছে। তারা ব্যবহার করছে পাম্প অ্যাকশন গান (পিএজি)। তারপরও মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়নি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে গতবছরও সীমান্তে ২৪ বাংলাদেশি নিহত হন। এদের মধ্যে ১৮ জন বিএসএফের গুলিতে ও ৬ জন নির্যাতনে মারা যান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

এর আগে ২০১৬ সালে সীমান্তে হত্যার ব্যাপারে যৌথ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বছর না ঘুরতেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে দেশ দুটি।

কিশোর রাসেল মিয়া প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে।

“সারা বিশ্বে এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি যে দেশের অধিবাসী সে দেশ, আক্রমণকারী দেশের প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। আর উচ্চকণ্ঠ হতে হয় সিভিল সোসাইটি, মানবাধিকার কর্মী, সংবাদপত্রকে,” ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারনিউজকে বলেন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।