এক দশক ভারতে জেল খেটে ফিরলেন নিরপরাধ বাদল
2018.07.06
ঢাকা
এক দশক আগে ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই আগ্রার তাজমহল দেখতে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বৈধভাবে ভারত যাচ্ছিলেন বাগেরহাটের বাদল ফরাজী। যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী–বিএসএফ।
ওই বছরের মে মাসে দিল্লির অমর কলোনীতে এক বৃদ্ধাকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় বাদলের বিরুদ্ধে।
হিন্দি বা ইংরেজি—কোনো ভাষায় দক্ষতা না থাকায় বাদল আত্মপক্ষ সমর্থন করতে ব্যর্থ হন। তিনি বোঝাতে পারেননি যে, ওই বৃদ্ধা হত্যার আসামি তিনি নন।
বৃদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ভারতীয় নাগরিক বাদল সিংয়ের বদলে বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। মূল হত্যাকারী বাদল সিংয়ের নামের সাথে মিল থাকায় শাস্তি পেতে হয় বাংলাদেশের এই যুবককে।
বিনা অপরাধে দিল্লির জেলে দশ বছর কাটানোর পর সেই বাদল ফরাজীকে শুক্রবার বিকেলে দিল্লি জেল থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুনিম হাসান।
“বাংলাদেশ পুলিশের দুজন কর্মকর্তা ভারতে গিয়ে বাদলকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। আইন অনুযায়ী, বাদল তার সাজার বাকি মেয়াদ বাংলাদেশের জেলে কাটাবেন,” জানান মুনিম হাসান।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটার পর বাদল ফরাজীকে দিল্লি থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয়। এরপর পুলিশ পাহারায় তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়।
পাসপোর্টে বাদলের স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাটের মংলা এলাকা। তিনি আবদুল খালেক ফরাজী ও সারাফালি বেগমের পুত্র।
মংলার ব্যবসায়ী আবু হাসান বেনারকে বলেন, বাদল নিরাপরাধ ছিলেন। এটা প্রমাণ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাঁকে সাধারণ ক্ষমা করতেই পারেন, সেটাই প্রত্যাশিত।
কীভাবে জানা গেল?
বাদল ফরাজীকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করার বিষয়ে দিল্লির সমাজকর্মী রাহুল কাপুর স্যোসাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন গড়ে তুলেছিলেন। ২০১৬ সালে রাহুল তিহার জেলে বাদলের মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁর একটি কাজের সূত্রে। সেই সময় দিল্লির একটি খুনের ঘটনায় তাঁকে আসামি করা ও সাজা দেওয়ার কাহিনী তুলে ধরেন বাদল। দিল্লির ইন্ডিয়া হোটেলের সামনে বাদলের মুক্তির জন্য বিক্ষোভ করেছিলেন রাহুল। এর পর তিনি সোসাল মিডিয়ায় স্বাক্ষর অভিযান শুরু করেন।
বাদল ফরাজীকে বিনা অপরাধে সাজা দেওয়ার ঘটনাটি ২০১২ সালে প্রথম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক ডেপুটি চিফ সালাউদ্দীন নোমান চৌধুরী বেনারকে বলেন, বিষয়টি জানার পর, বাংলাদেশ দূতাবাস বাদলের পক্ষে ভারতে আইনি লড়াই চালালেও কোনো লাভ হয়নি। মূল হত্যাকারী বাদল সিং এখনো ধরা পড়েনি বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুদেশের কর্মকর্তারা গত ফেব্রুয়ারি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে নিশ্চিত হন যে, বাদল প্রকৃত খুনী নয়। তাঁকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে।
এর প্রেক্ষিতে গত ১৯ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক জরুরি বৈঠক করে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২২ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে আবেদন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
যেহেতু ভারতের উচ্চ আদালতের রায় বাদলের বিপক্ষে, তাই ভারত সরকারের সাথে সম্পাদিত বাংলাদেশ-ভারত সাজাপ্রাপ্ত আসামি হস্তান্তর চুক্তির আওতায় বাদলকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় সরকার।
এই চুক্তি অনুযায়ী, বাদলই প্রথম বাংলাদেশি যাকে ভারতের জেল থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো বলে জানান মুনিম হাসান।
তবে প্রশাসনিক তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও হস্তান্তর চুক্তির আওতায় ফিরে আসার কারণে ভারতের আদালতে বাদলের এখন আর আপিল করার কোনো সুযোগ নেই বলে দৈনিক ডেইলি স্টারকে এক সাক্ষাৎকারে জানান নয়াদিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসের কনসুলার মোশাররাফ হোসেন।
চুক্তি অনুযায়ী ফিরে আসার পর “আপিলের কোনো সুযোগ নেই” এবং বাদলকে সাজার বাকি মেয়াদ “অবশ্যই বাংলাদেশে কাটাতে হবে,” জুন মাসের শেষের দিকে ডেইলি স্টারকে বলেন মোশাররাফ হোসেন।
থেমে থাকেননি বাদল
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাদল জানিয়েছেন, তাঁর শাস্তি হওয়ার অন্যতম কারণ ভাষার দুর্বলতা। তাই তিনি জেলের মধ্যেই হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা চর্চা করতে থাকেন।
মুনিম হাসান বলেন, কারাগারে বসে না থেকে বাদল ফরাজী পড়াশোনা চালিয়ে যান।
কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করে কারাগার চত্বরের ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন বাদল। স্নাতক ছাড়াও আটটি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেছেন তিনি।
বর্তমানে ইংরেজি ও হিন্দিতে অনর্গল কথা বলতে পারেন বাদল ফারাজী।
তার আচার ব্যবহারে সন্তোষ প্রকাশ করে জেল কর্তৃপক্ষ। তারা বাদলের সাজার মেয়াদ কমাতে কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে।
বাদলের বোন তাসলিমা বেগম বেনারকে বলেন, “আমার ভাই বিনা অপরাধে দশ বছর জেল খেটেছে। তার দশবছর তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সে নির্দোষ। তাকে কেন আবার কারাগারে থাকতে হবে। তাকে মাফ করে দেয়া হোক।”
চুক্তি থাকলেও কার্যকর ছিল না
ফৌজদারি মামলায় বিচারাধীন বা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিনিময়ে ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ভারতের সঙ্গে ‘বহিঃসমর্পণ চুক্তি’ করে বাংলাদেশ। ওই বছরের ৭ অক্টোবর এ চুক্তিতে অনুসমর্থন দেয় মন্ত্রিসভা। কিন্তু চুক্তিতে প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকায় বিষয়টি কার্যকর হয়নি।
ভারত সরকার বিষয়টি সহজ করার অনুরোধ করেছিল। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা ‘বহিঃসমর্পণ চুক্তি’ সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করে, এরপর ভারতেও বিষয়টি অনুমোদন হয়।
আট বছর আগে বাংলাদেশে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার সাজার মেয়াদ শেষ হলেও তাঁকে হস্তান্তরের বিষয়টি বহুদিন আটকে ছিল। বলা হচ্ছিল, আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকায় তাঁকে ফেরানো যাচ্ছে না।
একই জটিলতা ছিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলার আসামি নূর হোসেনের ক্ষেত্রেও। শেষপর্যন্ত তাঁদের হস্তান্তর করা হলেও তা বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় হয়নি বলে সে সময় জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
কীভাবে হস্তান্তর হয়েছে, সেই ব্যাখ্যায় তিনি সে সময় বলেছিলেন, এটা বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে হয়নি। তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার আগে সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে। ছেড়ে দেয়ার পর তারা নিয়ে গেছে।
গত মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বন্দী বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী বাদল ফরাজীকে প্রত্যর্পণের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কারা মন্ত্রী উজ্জল বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে অনেক বাংলাদেশী বন্দী রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি বন্দীদের প্রত্যর্পণের বিষয়ে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি লিখেছি।”
পশ্চিমবঙ্গের কারা দপ্তরের ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সংশোধনাগারগুলিতে বাংলাদেশের ১ হাজার ৫১৩ জন সাজাপ্রাপ্ত বন্দী রয়েছেন। বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যা ১ হাজার ৭৬৮ জন।
“দুই দেশের চুক্তি থাকলেও তা সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না। আমি মনে করি, দুই দেশের বন্দী প্রত্যর্পনের চুক্তি দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর হওয়া দরকার,” বলেন উজ্জল বিশ্বাস।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল।