ভারতে নির্বাচন: ‘ম্যাচ ফিক্সিংয়ের’ অভিযোগ মাথায় নিয়ে মোদির হ্যাট্রিক করার স্বপ্ন
2024.04.18
কলকাতা ও ঢাকা

বিরোধীদের তোলা ‘ম্যাচ ফিক্সিংয়ের’ অভিযোগ মাথায় নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ভারতের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন নরেন্দ্র মোদি। ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড়ো এই নির্বাচন, ভোটার প্রায় ৯৬ কোটি মানুষ।
বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত মোট সাত ধাপে অনুষ্ঠিত হবে অষ্টাদশ সংসদীয় নির্বাচন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন বলছে, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ত্রুটি রাখা হবে না।
নির্বাচন শুরুর আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলে আসছেন, লোকসভার মোট আসন ৫৪৩টি আসনের মধ্যে তাঁদের ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) এবার ৪০০ আসন পার করবে, যার মধ্যে তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একাই পাবে ৩৭০ আসন।
২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে ৩০৩টি আসন পেয়েছিল। আর এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৫২টি আসন।
সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলো বলছে, মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও এর মিত্ররা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয়ী হতে যাচ্ছে।
‘ম্যাচ ফিক্সিংয়ের’ অভিযোগ বিরোধীদের
বিরোধী দলগুলো বলছে, মোদি ক্ষমতায় থাকলে ভারতীয়রা অনেক বেশি স্বাধীনতা হারাতে পারে। তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগও এনেছেন।
নির্বাচনে মোদির প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া)। এই জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আছেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং দুই ভাই-বোন রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, যাদের বাবা রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
নয়াদিল্লিতে বিজেপিবিরোধী জোট ইন্ডিয়ার ‘লোকতন্ত্র বাঁচাও’ মিছিলে ভাষণ দেওয়ার সময় রাহুল বলেছেন, নির্বাচনের ম্যাচ শুরুর আগেই দুই খেলোয়াড়কে কারাবন্দি করেছেন মোদি।
কারাবন্দি দুই মুখ্যমন্ত্রী দিল্লির কেজরিওয়াল ও ঝাড়খণ্ড বিধান সভার হেমন্ত সরেনকে ইঙ্গিত করে তিনি এ কথা বলেন।
নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে মোদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করেছেন—ইঙ্গিত দিয়ে রাহুল বলেছেন, বিজেপি ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ করছে। তিনি আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদি ৪০০ আসন পার হতে আম্পায়ার বেছে নিয়েছেন।”
বর্তমানে কারাবন্দি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টিও (আপ) ইন্ডিয়া জোটে আছে। সঙ্গে আছে আরও কিছু শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল।

আলোচনায় গ্রেপ্তার, হয়রানি প্রসঙ্গ
আম আদমি পার্টি বলছে, মোদি ও বিজেপি আম আদমির নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে। এর লক্ষ্য দিল্লীতে বিজেপির শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
আন্তর্জাতিক নাগরিক অধিকার সংস্থা ফ্রিডম হাউস বলেছে, বিজেপি সরকারের সমালোচনা করা ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সাংবাদিকদের হয়রানি করার ঘটনা বাড়ছে। সংস্থাটি ভারতকে ‘আংশিকভাবে স্বাধীন’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছে।
কেজরিওয়াল ও হেমন্ত সোরেনকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআইসহ এজেন্সিগুলোকে অপব্যবহারের অভিযোগ বিরোধীরা প্রতি জনসভায় তুলে ধরেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা ব্যানার্জী এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার।
উত্তরবঙ্গে এক জনসভায় সম্প্রতি তিনি বলেন, “বিজেপি চায়, গোটা দেশে একটাই রাজনৈতিক দল থাকবে। তাদের নীতি ওয়ান নেশন, ওয়ান পলিটিক্যাল পার্টি; যা চলতে পারে না।”
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও বিজেপি তৃণমূলের থেকে বেশি আসন পেতে পারে বলে রাজনৈতিক মহল ধারণা করছে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনে ভোট হবে ৭ দফায়।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিক বিশেষজ্ঞ ড. রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী মনে করেন, বিরামহীন দুর্নীতি আর নেতাদের দৌরাত্ম্যে তৃণমূল কংগ্রেস এবার বেশ কোণঠাসা। তাই পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তৃণমূলের আসন আগের চেয়ে কমলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ভারতের প্রবীণ সমাজবিজ্ঞানী জাঁ দ্রেজ সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের গণতন্ত্র সংকটের দিকে চলছে। স্বৈরতন্ত্রের সাম্প্রতিক উত্থান এবং বিরোধীদের কণ্ঠস্বরকে যেভাবে বিজেপি দাবিয়ে দিচ্ছে, তাতে নির্বাচনী রিগিংয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বেনারকে বলেন, “বিজেপির বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগ তেমন কোনো কাজে আসবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে ভোট হচ্ছে, বিরোধীরা সেই ভোটে অংশও নিচ্ছেন।”
ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা বিরোধীদের এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না। বরং মোদি বলেছেন, দেশ যাতে দুর্নীতিমুক্ত হয় সেজন্য তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, তৃণমূল কংগ্রেস, বাম ও কংগ্রেস একে-অপরকে বাঁচাতে ইন্ডিয়া জোট তৈরি করেছে।
রাজাগোপাল বেনারকে বলেন, “ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় নির্বাচন হয় আবেগ নিয়ে। রাম মন্দির নির্মাণ, ভারতকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করাসহ কিছু কারণে দেশ আজ মোদিময়। এই স্রোতের বিপক্ষে লড়া বড়ো শক্ত কাজ।”
বাংলাদেশে আগ্রহ কম
প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে তেমন আগ্রহ নেই। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ভারতের প্রভাব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে—এমন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে যাচ্ছে।
ভারতীয় পণ্য বয়কটের বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, এটা কতটা হচ্ছে বা হবে তা এখন বলা কঠিন। ভারত ও আমাদের পারস্পারিকতার যে বিষয় আছে, সেটাও কিন্তু বেশ গভীর। কাজেই আমরা চাইলেই বা ইচ্ছা করলেই সব কিছু ঘটবে বা হবে এটা বলা মুশকিল।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা হচ্ছে একটি ভূ-রাজনৈতিক বা অবধারিত বাস্তবতা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের একটি ইতিহাস আছে এবং সম্পর্কে এক সময় অবনতিও হয়েছে। গত ১৫ বছরে সম্পর্কের যে গতিশীলতা এবং যে ধরনের স্থিতিশীল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে শুধু বাংলাদেশ-ভারত নয়, পুরো অঞ্চল সুবিধাভোগী হয়েছে।”
দেলোয়ার বলেন, “ভারতের নির্বাচনটি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, নতুন সরকার অনেক বড়ো বড়ো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থের বিষয় আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের জ্বালানি সহায়তা, বাণিজ্য, বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা থাকলে, রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক পর্যায়ে সম্পর্ক ভালো থাকলে এক ধরনের নিরাপত্তা বোধ তৈরি হয়।
হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ভারতে বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসবে। আমাদের এখন সেভাবেই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। ভারতে যদি এই সরকারই আসে তাহলে এখনকার যে কার্যক্রম চলমান আছে সেগুলো চলবে। বড়ো পরিবর্তন আসবে না।”
৪৩ দিন ধরে নির্বাচন, ফল প্রকাশ ১ জুন
তফসিল অনুযায়ী, ভারতের ১৮তম লোকসভার ৫৪৩টি আসনের জন্য ভোটগ্রহণ শুরু হবে ১৯ এপ্রিল। ৪৩ দিন ধরে সাত দফায় এই নির্বাচন শেষ হবে ১ জুন। ফলাফল প্রকাশ হবে ৪ জুন। প্রথম দফায় ১৯ এপ্রিল ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ১০২টি আসনে ভোট নেওয়া হবে।
পরবর্তী দফাগুলো হবে ২৬ এপ্রিল, ৭ মে, ১৩ মে, ২০ মে, ২৫ মে ও ১ জুন।
নির্বাচন কমিশন বলেছে, মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকই নারী।
নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা জানান, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিতে যাতে হতে পারে, সে জন্য স্থানীয় পুলিশের পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনীর তিন লাখ ৪০ হাজার অফিসার ও জওয়ান মোতায়েন করা হবে।