বাংলাদেশের অনলাইন স্বাধীনতা সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থানে: ফ্রিডম হাউস

সুবেল রায় ভান্ডারী , কামরান রেজা চৌধুরী
2021.09.21
কাঠমান্ডু, ঢাকা
বাংলাদেশের অনলাইন স্বাধীনতা সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থানে: ফ্রিডম হাউস দুই তরুণ ইন্টারনেট ব্রাউজিং করছে। ঢাকা, ৩০ আগস্ট, ২০২১।
বেনার নিউজ

­­­­বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট স্বাধীনতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ফ্রিডম হাউজ। বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের ইন্টারনেট স্বাধীনতা স্কোর ছিল ৪২ এবং এ বছর তা কমে হয়েছে ৪০, যা সর্বকালের সর্বনিম্ন।

এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে ২০১৮ সালে পাশ হওয়ার পর থেকে মত প্রকাশের জন্য কয়েক ডজন সাংবাদিক ও লেখকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারায় মামলা হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মীরা ফ্রিডম হাউজের এই প্রতিবেদন সঠিক বললেও সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবেদনকে ‘মনগড়া’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

২০২১ সালের এই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সরকারের সমালোচনা করা বিরোধী দলীয় সদস্য, সরকারের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এমন সম্ভাব্য ব্যক্তি, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে হয়রানি বেড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো এখনও খুলে দেয়া হয়নি।

করোনাভাইরাস মহামারির ওপর প্রকাশ হওয়া জাতিসংঘের প্রতিবেদনের ওপর সংবাদ প্রকাশ করায় বেনারনিউজ ও নেত্রনিউজ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গণমাধ্যম দুটি এখনও খুলে দেয়া হয়নি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্যাতন, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গুম এবং নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যুর কারণে সেল্ফ সেন্সরশীপ বিরাজ করছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলের পক্ষে প্রচারণার জন্য গত সপ্তাহে ১০ হাজার দলীয় নেতাকর্মীদের একটি কর্মী বাহিনী তৈরি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আল-জাজিরা ও ইসরাইলী পত্রিকা হারেটস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনলাইনে সরকারের তদারকি ও হ্যাকিং করার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এ বছর ইসরাইল থেকে তথ্য প্রযুক্তি ক্রয় করেছে সরকার।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে ইসরাইল থেকে কোন প্রকার তথ্য প্রযুক্তি অথবা কোন যন্ত্রপাতি ক্রয় করার কথা অস্বীকার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং দেশটির সাথে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।

প্রতিবেদন প্রত্যাখান সরকারের

ফ্রিডম হাউজের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, “আমি এ ধরণের প্রতিবেদন গ্রহণ করি না।”

“আপনি কি আর কিছু বলতে বলবেন,” বেনারনিউজ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না।”

ফ্রিডম হাউজের প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারের অবস্থানের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, “এসব ফ্রিডম হাউজের মনগড়া তথ্য।”

তিনি বলেন, “আমি যা মনে করি সেটি হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাথে ইন্টারনেট সংযোগ কোনওভাবেই যুক্ত নয়। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।”

মন্ত্রী বলেন, “সরকার কোনওভাবেই জনগণের ইন্টারনেট স্বাধীনতা খর্ব করছে না।”

“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সম্ভাব্য অপব্যবহার বন্ধ করতে আমরা ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছি,” জানান আনিসুল হক।

তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পর্যালোচনার জন্য জাতিসংঘের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

অন্যরা বলছে প্রতিবেদন ঠিক আছে

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্টারনেট স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন আর্টিকেল-১৯ এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো জনগণের ইন্টারনেট স্বাধীনতা খর্ব করে—ফ্রিডম হাউজের এই মতামতের সাথে আমি একমত।”

তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করি। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকেন। সার্বক্ষণিক এই ভীতির কারণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।”

তিনি বলেন, “তবে দেশের বাইরে যে বাংলাদেশিরা বসবাস করেন, তাঁরা সর্বোচ্চ ইন্টারনেট স্বাধীনতা উপভোগ করেন।”

ফারুক ফয়সাল বলেন, একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপরে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করিয়েছে আর্টিকেল-১৯।

“এই সমীক্ষায় দেখা গেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারাই ইন্টারনেটের স্বাধীনতা এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। আমরা আমাদের সমীক্ষাটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছি।”

বাংলাদেশে ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পাশ করে বিএনপি সরকার।

এই আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা সম্পর্কে অধিকার কর্মীদের ব্যাপক আপত্তি ছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই আইনের সংশোধনী এনে ৫৭ ধারার অধীন অপরাধের সাজা বৃদ্ধি করে আওয়ামী লীগ সরকার।

মানবাধিকার কর্মীদের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করে সরকার।

তবে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করে সরকার। এই আইনে ৫৭ ধারার চেয়েও কঠোর বিধান সংযোজন করা হয় বলে অভিযোগ করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

এই আইনে মামলা হলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং আদালত থেকে জামিন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা বিভিন্ন মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ সম্পর্কে ফিডম হাউজের প্রতিবেদন সঠিক বলে আমি মনে করি।”

তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন খুব কঠোর আইন এবং এটি জনগণের ইন্টারনেট স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে।”

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে মানুষের মধ্যে সেল্ফ সেন্সরশীপ বেড়েছে। জনগণ যা মনে করে তা প্রকাশ করতে পারে না।”

তিনি বলেন, “কেউ যদি অনলাইনে আরকেজনকে আঘাত করে, কটু কথা বলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই তার সাজা হওয়া উচিত। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এর বিচার করা সম্ভব। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় তাকে বিচার করার কোন প্রয়োজন নেই।”

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “সরকার আনলাইনে মানহানির ব্যাপারে বেশি মনোযোগী। ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখে মানহানি করলে সর্বোচ্চ মাত্র পাঁচ হাজার টাকা অথবা দুই বছরের কারাদণ্ড। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একলাইন লিখলে সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা জরিমানা। এই ধারা বৈষম্যমূলক। আইন বৈষম্যমূলক হতে পারে না।”

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছাড়াও সামরিক জেনারেলের শাসনে থাকা থাইল্যান্ডে ইন্টারনেট সাংঘাতিক রকমের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও ইন্টারনেট স্বাধীনতা কমেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।