স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে নীতি নির্ধারকরা বিদায়, নতুন নেতৃত্বে ইসলামী ব্যাংক

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.01.06
ইসলামী ব্যাংকের সর্বশেষ ব্যবসা পর্যালোচনা সভা। পদত্যাগ করা ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মান্নানের সভাপতিত্বে ইসলামী ব্যাংকের সর্বশেষ ব্যবসা পর্যালোচনা সভা। জানুয়ারি ০১, ২০১৭।
ইসলামী ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগ।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এসেছে নতুন মুখ। নির্বাহী ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান পদেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।

সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান হয়েছেন ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান। ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ। ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হামিদ মিয়া ব্যাংকটির নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার, ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। আবদুল মান্নানের চাকরির মেয়াদ আরও ৬ মাস ছিল। চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও ব্যাংকটির পরিচালক ও ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদ থেকেও পদত্যাগ করেন মুস্তাফা আনোয়ার।

স্বাস্থ্যগত কারণে পুরোনোরা পদত্যাগ করায় পরিচালনা পর্ষদ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে বিভিন্ন পদে নতুন নিয়োগ দিয়েছে বলে বেনার নিউজকে জানিয়েছেন আরাস্তু খান। ব্যাংকটি ইসলামি ধারায় সততার সঙ্গে আগের মতোই ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাবে বলেও তিনি জানান।

সাবেক আমলা আরাস্তু খান বেসরকারি মালিকানাধীন কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। গত বছর ১১ জানুয়ারি ৩ বছরের জন্য এই পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। আরমাডা স্পিনিং মিলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে আরাস্তু খান ব্যাংকের পরিচালক এবং চেয়ারম্যান হন। তিনি কমার্স ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করে ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

সভায় মেজর জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিনকে নির্বাহী কমিটি, ড. মো. জিল্লুর রহমানকে নিরীক্ষা কমিটি এবং পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবদুল মাবুদকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান করে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে সৌদি আরবের আল-রাজি কোম্পানির প্রতিনিধি ইউসুফ আবদুল্লাহ্ আল-রাজী পুনঃ নির্বাচিত হয়েছেন। একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি শেয়ার রয়েছে আল-রাজি’র।

ইসলামী ব্যাংক উত্তরা শাখা। ফাইল ছবি।
ইসলামী ব্যাংক উত্তরা শাখা। ফাইল ছবি।
স্টার মেইল
রাজনৈতিক বিরোধের কেন্দ্রে

জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতা থাকায় ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক হিসেবে পরিচিত পায়। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবিরের নেতা কর্মীদের চাকরির প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবেও এই ব্যাংকটি পরিচিত।

জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিনিধি হিসেবে এত দিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন মুস্তাফা আনোয়ার। ইবনে সিনা ট্রাস্টের সাবেক চেয়ারম্যান যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত মীর কাসেম আলী ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ভাইস চেয়ারম্যান। জামায়াত সংশ্রবের কারণে ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে আন্দোলনকারীরা। এর আগে ব্যাংকটি বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ উঠেছিল।

জামায়াতের হাতছাড়া

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ছিল ইসলামী ব্যাংকের ওপর। ২০১০ সালে এই ব্যাংকে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। জামায়াতের খপ্পর থেকে ব্যাংকটিকে বের করে আনতে বেশ কিছুদিন ধরে এটির মালিকানা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ধাপে ধাপে পরিবর্তন আসছিল। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তেই ব্যাংকটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি চিঠি উদ্ধৃত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, জামায়াতের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত এমন পরিচালক ও কর্মকর্তাদের ইসলামী ব্যাংক থেকে সরিয়ে দিতে ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ আল-রাজি আগেই সম্মতি দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর সঙ্গে এক বৈঠকে এমন মত দেন ইউসুফ আল-রাজি।

তবে নতুন ভাইস চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার বেনার নিউজকে বলেছেন, “পরিচালনা পর্ষদের সভায় যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তার সবটাই হয়েছে স্বেচ্ছায় এবং শান্তিপূর্ণভাবে। জনগণের আমানত রক্ষা করা এবং ব্যাংকটির অগ্রগতি বজায় রাখার জন্য ব্যাংকটির নতুন নেতৃত্ব নিরলসভাবে কাজ করে যাবে।”

স্বাগত জানিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ মহল

যুদ্ধাপরাধের বিচার, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ ইসলামী ব্যাংকের নেতৃত্বে এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেশকে জঙ্গিবাদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট নয় বলে তারা মনে করছেন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বেনার নিউজকে বলেছেন, “শুধুমাত্র কসমেটিক পরিবর্তন করে কাজ হবে না। দেশকে বাঁচানোর জন্য ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনাসহ জামায়াতের মালিকানাধীন সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া দরকার।”

শহিরিয়ার বলেন, ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান থেকে অফিস সহকারি ও নিরাপত্তাকর্মী পর্যন্ত সব স্তরে জামায়াতের লোকজন চাকরি করছেন। এরা জামায়াতের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে। সকল পদে পরিবর্তন আনতে আইনগত সমস্যা আছে। এ জন্য আগে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা দরকার।

মৌলবাদের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত। বেনার নিউজকে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় মৌলবাদ তথা জঙ্গিবাদ প্রবিষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রধান অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক। এটি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া উচিত। ব্যাংকটি কী ধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন করছে তা নিয়মিত তদারকি দরকার।”

মুনাফার শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক

১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম শরিয়া ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। মোট ৩১৮টি শাখা নিয়ে এই ব্যাংকটি বর্তমানে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ।

শুরুতে ইসলামী ব্যাংকের ৬৩ শতাংশের বেশি মালিকানা ছিল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ১৩টি প্রতিষ্ঠানের। তবে গত দুই-তিন বছরে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকে তাদের মালিকানা ছেড়ে দেওয়ায় উদ্যোক্তা অংশের পরিমাণ কিছুটা কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বরাবরের মতো ২০১৬ সালেও মুনাফার শীর্ষে ছিল ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি বিদায়ী বছরে মুনাফা করেছে রেকর্ড ২ হাজার ৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল এক হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধিসহ ইসলামী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেশি।

ব্যাংকটির গ্রাহকসংখ্যা এখন ১ কোটি ২০ লাখ। গত পাঁচ বছরে আমানত, বিনিয়োগ ও গ্রাহক সংখ্যাসহ বিভিন্ন সূচকে ব্যাংকটির সার্বিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।