জাতীয় পার্টি মৌলিক মানবাধিকার ফিরিয়ে আনবে, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করবে
2023.12.21
ঢাকা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে দেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের ইশতেহার প্রকাশ করেছে জাতীয় পার্টি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে যাওয়া এবং তৃতীয়বারের মতো বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য প্রস্তুত দলটির এই বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি’ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও আসন ভাগাভাগি করার বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক কৌশল’ বলেই দাবি করে আসছে দলটি। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে পারলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই জয় লাভ করবে তারা।
বৃহস্পতিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
ইশতেহারে মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার কথা বললেও সংসদে বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি কখনোই জোর গলায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবাধিকার বা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। দলটি মূলত রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির সমালোচনা করে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমালোচক ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ান্থ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “জাতীয় পার্টি গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগী হয়ে সরকারের সব অপকর্মকে বৈধতা দিয়ে এখন তারা বলছে, তারা ক্ষমতায় গেলে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করবে। এটি রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু না।”
তিনি বলেন, “তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষি করার পরে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন তারা বলছে, মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করবে।”
সাখাওয়াত বলেন, “জাতীয় পার্টি এই কথা বলে দেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। সুষ্ঠু ভোট হলে এই দল তিন থেকে চারটি সিট পেতে পারে বলে তাদের দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছেন।
“জাতীয় পার্টির সর্বশেষ যে তৃণমূল কর্মী সমাবেশ হয়, সেখানে ঢাকার এক নেতা ছাড়া সবাই একবাক্যে নির্বাচন বয়কট করার মত দেন। কিন্তু দলটি কিছু আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে গিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।”
বিএনপি জোট ও তার যুগপৎ আন্দোলনের শরিক অভিযোগ করে আসছে, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে এবং দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে।
নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণাকালে চুন্নুও একই অভিযোগ তোলেন। যদিও আওয়ামী লীগ মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দেশের ইতিহাসে এত উন্নয়ন অতীতে কখনো হয়নি। দরিদ্র বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব।
জাতীয় পার্টির ইশতেহার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বেনারকে বলেন, “দেশে মৌলিক মানবাধিকার নেই—অন্যান্য বিরোধী দলগুলো যেমন কথা বলে থাকে, জাতীয় পার্টিও তেমন একটি কথা বলেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু না।”
তিনি দাবি করেন, “বাংলাদেশে মানবাধিকার যতটুকু রক্ষিত, মানবাধিকারের প্রবক্তা দেশগুলোতেও ততোটা মানবাধিকার রক্ষিত নয়।”
জাতীয় পার্টি মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনবে বলতে কি বুঝিয়েছে-বেনারের পক্ষ থেকে প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, “অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ দেশের সংবিধানে জনগণের জন্য যেসব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিশ্চিত করা হবে।”
তিনি বলেন, “দেশে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করাসহ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে জাতীয় পার্টি।”
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে র্যাবের ওপর মার্কিন সরকারের অবরোধ আরোপের পূর্ব পর্যন্ত কয়েকশ মানুষ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই।
২০১২ সালের এপ্রিলে ঢাকা থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
র্যাবের হাতে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁকে যখন গুলি করে হত্যা করা হয় তখন মোবাইল ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন একরামের স্ত্রী। তিনি সেই ফোন রেকর্ড প্রকাশ করলেও কোনো সুরাহা হয়নি।
আওয়ামী লীগ আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যরা একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। “মায়ের ডাক” নামে এই সংগঠনের ব্যানারে প্রায়ই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বরাবর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। এর আগে তিনি বেনারকে বলেন, নানা কারণে অনেক মানুষ ইচ্ছা করে লুকিয়ে থাকে এবং পরিবারের সদস্যরা গুম বলে অভিযোগ করে।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার বলতে কী করতে চায় তাঁর দল এমন প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব চুন্নু বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচন প্রশ্নাতীতভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রতিটি নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো না কোনো দল প্রশ্ন তুলেছে। সে কারণে এই ব্যবস্থায় দেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, “আমাদের প্রস্তাব অনুসারে, দেশের ৩০০ আসনে সরাসরি প্রার্থী নির্বাচনের পরিবর্তে দলকে ভোট দেবে জনগণ। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে দল প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী আসন পাবে। দলগুলো তাদের পছন্দ মতো প্রার্থীকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করে সংসদে পাঠাবে।”
১৯৮২ সালের মার্চে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ।
সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে গঠন করেন রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি। তাঁর নয় বছরের শাসনামলকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি স্বৈরশাসন চিহ্নিত করে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন এরশাদ।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কারারুদ্ধ হন এরশাদ। ওই নির্বাচনে কারাগারের ভেতর থেকে এরশাদ পাঁচটি আসনে জয় লাভ করেন। তাঁর দল ৩৬টি আসনে জয় লাভ করে।
১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ এবং কারামুক্ত হন এরশাদ।
২০০৭ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত বিরোধী অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। পরের বছরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি। এরশাদের ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন।
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি-জামায়াত। ওই নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। ওই সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় বসতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি, যা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে গেছে।