উপকূলে ভেসে আসছে মৃত জেলিফিশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.03.26
ঢাকা
উপকূলে ভেসে আসছে মৃত জেলিফিশ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে জোয়ারের সঙ্গে ভেসে আসছে শত শত জেলিফিশ। ছবিতে কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে আটকে পড়ে কিছু মৃত জেলিফিশ। ১৮ মার্চ ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

গত সপ্তাহখানেক ধরে অসংখ্য মৃত জেলিফিশ ভেসে আসছে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ উপকূলে। আর এই বিষয়টিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে গবেষকরা বলছেন, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সৈকতে কেন এত জেলিফিশ মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।

তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে সাগরের পানির তাপমাত্রা, সেই সঙ্গে বাড়ছে দূষণ।  পানিতে তাপমাত্রা বাড়ায় জেলিফিশের দ্রুত বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, আর দূষণের কারণে তারা মারা যাচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর উপপরিচালক ও জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক ড. মিজান আর. খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরের উপরিভাগে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।

“সাগরের বিভিন্ন প্রাণী একেক তাপমাত্রা ও অবস্থায় বিকশিত হয় অথবা হুমকির মুখে পড়ে। জেলিফিশ সংবেদনশীল প্রাণী।  তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে এদের দ্রুত বংশ বৃদ্ধি হয়,” যোগ করেন তিনি।

ড. মিজান বলেন, “আমরা দেখছি, শত শত বড় আকৃতির মৃত জেলিফিস সাগর সৈকতে ভেসে আসছে, এটি ভালো খবর নয়।  আবার পানিতে তাপমাত্রা বাড়লে ও জেলিফিসের দ্রুত বংশ বিস্তার হলে আমাদের মৎস সম্পদের ওপর বিরাট প্রভাব পড়বে।  এগুলো ছোট ছোট মাছের ডিম ও লার্ভা খেয়ে ফেলে।  এতে মৎসজীবীর জীবন-জীবিকাও হুমকিতে পড়বে।” 

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক সোমবার বেনারকে বলেন, “সামুদ্রিক দূষণ জেলিফিশের মৃত্যুর একটি কারণ হতে পারে।  তবে সুনির্দিষ্ট কোন কারণে এতোসংখ্যক জেলিফিশ বছরের এই সময়ে মারা যাচ্ছে, সেটি নিয়ে বড় গবেষণা হওয়া দরকার।”

কিছুটা ভিন্নমত দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক এবং সমূদ্রবিষয়ক গবেষক ড. মোহাম্মদ আল আমিন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে, সেটি ঠিক।  কিন্তু এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জেলিফিসের সংখ্যা বেড়েছে কিনা সেটি সরাসরি বলা কঠিন। 

“আইন অনুযায়ী জেলিফিস কিন্তু ইনডেনজারড (সঙ্কটাপন্ন) প্রজাতির।  কেউ জেলিফিস মারলে অথবা বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সরকার,” যোগ করেন তিনি।

ড. আল আমিন বলেন, “প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন দুষিত পদার্থ বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে।  সামুদ্রিক দুষণের কারণে জেলিফিস মারা গিয়ে থাকতে পারে।  আমি মনে করি সরকারি উদ্যোগে এ বিষয়ে শিগগির গবেষণা হওয়া দরকার।”

কুয়াকাটা-কক্সবাজারে অসংখ্য মৃত জেলিফিশ

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহে পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা উপকূলে শত শত মৃত জেলিফিশ ভেসে আসছে, সেগুলোর একেকটির ওজন গড়ে চার থেকে পাঁচ কেজি।  মৃত মাছ পচে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, জোয়ার-ভাটায় তা আবার পানিতে মিশে যাচ্ছে।

পটুয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “গত কয়েক বছর কিছু জেলিফিশ মারা যাচ্ছে, কিন্তু এবার এই সময় কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম দিকে লেম্বুরচর থেকে পূর্বে গঙ্গামতী পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিপুল সংখ্যক মৃত জেলিফিশ পড়ে আছে।  গত সপ্তাহখানেক ধরে মৃত জেলিফিশ ভেসে আসছে।”

“বন বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপকূলে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন, তবে কেন এত জেলিফিশ মারা যাচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন,” বলেন তিনি।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কুয়াকাটার লেম্বুরচর, চরবিজয় ও আশেপাশের এলাকায় একসঙ্গে শত শত মৃত জেলিফিশ ভেসে আসে।  ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সৈকতে কয়েকশ মৃত জেলিফিশ দেখা যায়, যার কোনো কোটির ওজন ছিল ১৭ কেজি পর্যন্ত।  গত বছর কক্সবাজার উপকূলে মৃত জেলিফিশ ভেসে আসে মার্চ মাসে।  এ বছরও কক্সবাজারে বেশি কিছু মৃত জেলিফিশ পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য, নামে ফিশ বা মাছ হলেও জেলিফিশ আসলে মাছ নয়।  এদের বাহ্যিক গঠনের সাথে মাছের গঠনের কোন ধরনের মিল নেই। এরা মূলত নিডারিয়া পর্বের অমেরুদন্ডী প্রাণি, যার মাছের মতো আঁশ, ফুলকা বা পাখনা থাকে না।  তাদের শরীর ৯৮ ভাগ পানি দিয়ে গঠিত।  কোনো মস্তিষ্ক নেই, কেবল একটি প্রাথমিক স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ সোমবার বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন সৈকতে মৃত জেলিফিশ দেখা যাচ্ছে।  এটি জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ফলাফল বলা যায়।”

সমুদ্রে প্লাস্টিক নিক্ষেপ দূষণের একটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা গবেষণা করে মাইক্রোপ্লাস্টিকও পেয়েছি।”

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজুম এলাকার মৎস্যজীবী আব্দুস শুকুর এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমরা কুয়াকাটা এলাকায় মাছ ধরতে যাই।  আগে সেখানে যত মাছ পাওয়া যেত এখন আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না।  প্রায়ই জালে জেলিফিশ ধরা পড়ে।”

তৌহিদা বলেন, “জেলিফিশ বিভিন্ন মাছের পোনা খেয়ে ফেলে।  যে কারণে জেলিফিশের সংখ্যা বেড়ে গেলে মাছ কমে যায়।”

মার্কিন উন্নয়ন সহায়তা সংস্থা ইউএসএইডের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের উপরিভাগের পানির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৯ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস।

২০২০ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে ৩০ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয়েছে ২৭ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ১০০ বছরে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ উপকূলে তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ওই গবেষণা অনুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে দুই লাখ টন প্লাস্টিক বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে।  এছাড়া, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে প্রচুর দূষিত পদার্থ সাগরে মিশে যাচ্ছে।

জেলিফিশ নিয়ে গবেষনা শুরু

সমুদ্রের জেলিফিস ক্ষতিকর এবং খাওয়ার অনুপযোগি বলে বাংলাদেশে ধারণা করা হয়।  তবে এই প্রথমবারের মতো কক্সবাজার উপকূলে খাওয়ার উপযোগী তিনটি এবং একটি বিষধর জেলিফিসের প্রজাতি শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা।

গত বছরের আগস্ট থেকে জেলিফিশ নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো গবেষনা শুরু হয়।  বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৌমিত্র চৌধুরী এবং সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন সিদ্দিক এই গবেষনা দলের নেতৃত্বে রয়েছেন।

তাদের প্রাথমিক গবেষণায় ওঠে আসে লবণেমইডস রোবাস্টাস বা ‘ধলা নুইন্যা/বর নুইন্না’, ‘ক্রেম্বায়োনেলা’ বা ‘বল নুইন্না’ এবং অরেলিয়া অরিটা বা ‘গেলাস নুইন্না’-এই তিন প্রজাতির জেলিফিস খাওয়ার উপযোগী।

গত বছরের ৮ নভেম্বর পেঁচারদ্বীপ উপকূলে জেলেদের জালে আটকা পড়ে দুটি জেলিফিশ।  সেগুলো ঘোস্ট জেলিফিশ বা সায়ানিয়া নোজাকি প্রজাতির বিষধর জেলিফিশ হিসাবে শনাক্ত করা হয়, যেটি স্থানীয়দের কাছে ‘গরু নুইন্না’ ও ‘হাতি নুইন্না’ নামে পরিচিত।

বিশ্ব জেলিফিশ দিবস উপলক্ষে গত বছরের ৩ নভেম্বর কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটে আয়োজিত সেমিনারে তুলে ধরা তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় দুই হাজার প্রজাতির জেলিফিশ রয়েছে।  এর মধ্যে ১২ প্রজাতির জেলিফিশ খাওয়ার উপযোগী। বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, ঔষধ শিল্পে এবং বিশ্বজুড়ে পাবলিক একুরিয়ামে জেলিফিশ প্রদর্শিত হয়।

সেমিনারে পাঠ করা প্রবন্ধে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি জেলিফিশের দাম ১০ ডলার বা ১১০০ টাকা।  এশিয়ার কিছু দেশে জেলিফিশ হাড় ও পেশীর ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।  থাইল্যান্ড জেলিফিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।