কারও নৈতিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করতে আদালতের অনুমতি লাগবে
2022.07.25
ঢাকা

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি অনুযায়ী প্রায় দেড়শ বছর পর সংশোধন করা হচ্ছে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারা। ভুক্তভোগী নারীদের অনেকেই এসব ধারার কারণে সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত ১৫৫(৪) ধারা বাতিল এবং ১৪৬(৩) ধারা সংশোধন করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এর ফলে আদালতের অনুমতি ছাড়া ভুক্তভোগীর নৈতিক চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন করা যাবে না বলে বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
ধারা ১৫৫(৪) অনুযায়ী আদালতে জেরা করার সময় ধর্ষণের বিচার প্রার্থীকে তার অতীত যৌন জীবন এবং নৈতিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যায়।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এই ধারার কারণে ধর্ষকদের আইনজীবীরা আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিচারপ্রার্থী একজন দুশ্চরিত্রবান নারী এবং তিনি স্বেচ্ছায় যৌনকর্ম করেছেন।
এ ছাড়া ১৪৬(৩) বিধান অনুযায়ী ধর্ষণ মামলার সাক্ষীদের নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার রয়েছে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়ায় কোনও ভুক্তভোগীকে জেরা করার সময় তার চরিত্র নিয়ে আদালতে প্রশ্ন করা যায়।”
তিনি বলেন, “এ ছাড়াও, বিদ্যমান এই আইন অনুযায়ী বিচারের সময় ধর্ষণের শিকার বিচারপ্রার্থীর যৌনজীবন নিয়েও প্রশ্ন করা যাবে।”
মন্ত্রী বলেন, “তবে আজ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সাক্ষ্য আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ফলে ধর্ষণের বিচার প্রার্থীর অতীত যৌনজীবন নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। এ ছাড়া, আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনও সাক্ষীর নৈতিক চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন করা যাবে না।”
তিনি বলেন, “জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে বিধান দুটি বিল আকারে উত্থাপন করা হবে এবং আশা করা যায় এগুলো আইনে পরিণত হবে।”
আনিসুল হক বলেন, “সরকার মানবাধিকার সংগঠনসহ সবাইকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, এই বিধান দুটি পরিবর্তন করা হবে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সোমবার বেনারকে বলেন, সরকার ধর্ষণের বিচার প্রার্থীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা বন্ধ করতে ১৫৫(৪) ধারা বাতিল এবং ১৪৬(৩) ধারা সংশোধন করেছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে প্রবর্তিত বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত করতে ১৮৭২ সালে সাক্ষ্য আইন চালু করে ব্রিটিশ সরকার। এই আইন অনুযায়ী এখনও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারা ধর্ষণের বিচার বাধাগ্রস্ত করে বলে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছিল।
এই ধারা দুটো সাক্ষ্য আইন থেকে বাদ দিতে আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেছিল বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং আরও কয়েকটি বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন।
রিট শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন আদালতে জানান, সরকার ইতোমধ্যে সাক্ষ্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। সেকারণে আদালত থেকে এ ব্যাপারে আদেশ দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আয়েশা আক্তার সোমবার বেনারকে বলেন, “অধিকার কর্মীরা অনেকদিন ধরে এই ধারাটি বাদ দেয়ার জন্য সরকারসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে আসছেন। নতুন এই বিধানের ফলে বিচারকদের আরও বেশি দায়িত্ব দেয়া হলো।”
তিনি বলেন, “আমরা এমন বিচার ব্যবস্থা চাই, যেখানে একজন যৌনকর্মী আদালতে বলতে পারেন যে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি করা হয়েছে অথবা তাঁকে যৌনকর্ম করতে বাধ্য করা হয়েছে। অতীত যৌন কর্মের কারণে বিচার বঞ্চিত হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।”
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “যে কোনও বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষী হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাক্ষ্য প্রক্রিয়ায় কোনও প্রকার ভুল হলে বিচার পাওয়া যাবে না।”
তিনি বলেন, “তবে এটি সত্য, আদালতে একজন ধর্ষণের বিচার প্রার্থীকে আজেবাজে, নোংরা প্রশ্ন করে বিব্রত করা হয়। আইন অনুযায়ী বিচারপ্রার্থী এবং সাক্ষীরা সুরক্ষিত থাকলেও খুব বাজে ভাষায় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা প্রশ্ন করে থাকেন। এটি ন্যায় বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।”
মাহবুব হোসেন বলেন, “ধর্ষণের শিকার নারীদের অনেকেই বিশেষ করে সম্মানজনক পরিবারের সদস্যরা ধর্ষণের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করেন না বা বিচার চান না। এর অন্যতম কারণ আদালতে ধর্ষণের শিকার নারীকে জেরার নামে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা এবং তাকে আরেক দফা হয়রানি করা।”
তিনি বলেন, “মন্ত্রিসভা আজ সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারার যে সংশোধনী এনেছে, এটা ন্যায় বিচারের স্বার্থেই দরকার ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন অনেক মামলা পাই যেগুলো মিথ্যা। কিছু নারী প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে অথবা ব্ল্যাকমেইল করতে অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে অথবা অন্যকোনও ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অথবা বাধ্য হয়ে ধর্ষণ মামলা করে থাকে।”
মাহবুব হোসেন বলেন, “এমনও দৃষ্টান্ত আছে যে, একই নারী বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। আমরা মনে করি, সেসব ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে সাক্ষীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা দরকার।