পাটের মৌসুমে সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ায় সংকটে কৃষক
2020.07.06
ঢাকা
মাত্র মাস খানেকের মধ্যেই খেতের পাট কাটতে শুরু করবেন কৃষকরা। ঠিক এই সময়ে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দেশের চল্লিশ লাখ পাটচাষি।
ইতিহাসে এবারই প্রথম সরকারিভাবে কৃষকদের কাছ থেকে পাট কেনা হবে না। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ফলে পাটচাষিদের নির্ভর করতে হবে শুধু বেসরকারি পাটকল মালিকদের উপর। এতে পাটের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন তাঁরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গতবারের চেয়েও বেশি জমিতে পাট ফলিয়েছেন কৃষকরা।
“আমাদের এলাকায় কৃষকরা প্রায় সবাই পাট চাষ করেন। আমি নিজে এক একর জমিতে পাট আবাদ করেছি। সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ায় আমরা সবাই এখন দুশ্চিন্তায় আছি,” বেনারকে বলেন শরিয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার সিদলকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, “সরকার পাট না কিনলে ভালো দাম পাওয়া যাবে না। ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”
সাধারণত প্রতি মণ পাট উৎপাদনে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা খরচ হয় জানিয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, গতবছর প্রতি মণ পাট বিক্রি হয়েছে গড়ে ১৯০০ থেকে ২০০০ টাকায়।
চলতি মৌসুমে প্রায় একমাস খরার কারণে এবার তাঁর এলাকায় পাটের ফলন কিছুটা কম হলেও উপযুক্ত দাম পেলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু দাম পাওয়া না গেলে বড় সমস্যা হবে।”
প্রসঙ্গত, চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৫ টি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় দেওয়া হবে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিককে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গত বছরের ৫ মার্চ জাতীয় সংসদকে জানান, বাংলাদেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকলের সংখ্যা মোট ২৮১টি। এরমধ্যে ৫৬টি পাটকল বন্ধ এবং ২২৫টি চালু আছে।
সরকারের ২২টি পাটকল এবং ৩টি নন-জুট মিলের সবগুলোই এখন বন্ধ হয়ে গেলো।
সরকার লোকসানের কারণে সবগুলো মিল বন্ধ করলেও বেসরকারি পাটকলগুলো লাভেই পরিচালিত হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের পর দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের জায়গায় রয়েছে পাট। তৈরি পোশাক খাতে গত বছর মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলার।
বেসরকারি খাত লাভজনক হলেও সরকারের পাটকলগুলো গত ১০ বছরে ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এই ১০ বছরের মধ্যে একবারই, ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা মুনাফা হয়।
সরকারি কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। আর সব মিলে পাট শিল্পে জড়িত রয়েছেন এক লাখ ৬৫ হাজারের বেশি শ্রমিক।
উৎপাদন বেড়েছে, রপ্তানি বাড়বে
এবার সারাদেশে সাত লাখের বেশি হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে বলে জানায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গত বছর পাট আবাদের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ১৮ হাজার হেক্টরের কিছু বেশি জমি।
দেশীয় পাটকলগুলোই এসব পাটের মূল ক্রেতা। এর বাইরে প্রায় ১৪ লাখ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি হয়। সরকারি এবং বেসরকারি মিলগুলো যৌথভাবে ৬০ লাখ বেলের অধিক পাট ব্যবহার করে।
“বেসরকারি মিলগুলো পাটের বড় ক্রেতা। সরকারি পাটকল ১০ শতাংশের কম পাট ব্যবহার করে,” বেনারকে বলেন বিজেএমসি’র চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ।
“বিজেএমসি এবার পাট কিনবে না। আমাদের পাটকল যেহেতু বন্ধ সুতরাং এবার পাট কেনার কোনও সিদ্ধান্ত নেই,” বলেন তিনি।
পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ায় বিজেএমসিও বন্ধ হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিজেএমসি আছে, থাকবে। তবে কোন ফরমে থাকবে তা পরবর্তিতে সিদ্ধান্ত হবে।”
মাগুরা জেলার পাট ব্যবসায়ী শ্যামল মজুমদার বেনারকে বলেন, “পাট কাটার মৌসুমের শুরুতে সরকারি মিলগুলো যে দাম নির্ধারণ করে তার উপরই পাটের বাজারে ভারসাম্য থাকে। দাম সাধারণত সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে খুব একটা এদিক সেদিক হয় না। এবার সেই ভারসাম্য শেষ হয়ে গেলো।”
সরকার যেহেতু এবার পাট কিনছে না, তাই কাঁচা পাট রপ্তানি বাড়বে বলে বেনারকে জানান বহুমুখী পাটপণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি রাশেদুল করিম।
এ বছর করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে “আন্তর্জাতিক বাজার কেমন থাকবে তা বলা যায় না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কৃষকদের রক্ষা করতে হলে সরকারের উচিত হবে ভরা মৌসুমে বিজেএমসি’র মাধ্যমে পাট ক্রয় করা। ভারতে সরকারি মিল নেই। কিন্তু কৃষকদের স্বার্থে সরকার সেখানে পাট ক্রয় করে।”
তবে তাঁর মতে কৃষকদের জন্য এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
“কারণ বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ হচ্ছে এবং পাটের ব্যাগের চাহিদা বাড়ছে,” বলেন তিনি।
সরকারি মিল বন্ধ হলেও পাটের দামের ওপর তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না মন্তব্য করে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এসোশিয়েসনের মহাসচিব শহিদুল করিম বেনারকে বলেন, “বরং পাটজাত পণ্যের বদলে কাঁচা পাট রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে।”
“বেসরকারি মিলগুলো বছরে প্রায় ৫৫ লাখ বেল পাট ক্রয় করে। দেশে যে পরিমাণ পাট উৎপাদিত হয়, চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি আছে” বলেন শহিদুল করিম।
তবে বাংলাদেশ জুট এসোশিয়েসনের মহাসচিব আব্দুল কায়ুমের মতে পাটকল বন্ধ হওয়ার প্রভাব কৃষকদের ওপরও পড়বে।
“কারণ সরকার যে পাট কিনত সেটাই ছিল বাজারের ভারসাম্য। দামটা কৃষকদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে এ বছর কাঁচা পাট রপ্তানি উন্মুক্ত রাখতে হবে,” বলেন তিনি।