খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচারের যৌক্তিকতা নিয়ে আদালতে বিতর্ক

জেসমিন পাপড়ি
2018.09.24
ঢাকা
180924_KHALEDA_1000.jpg দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে ঢাকার বকশীবাজারে বিশেষ জজ আদালতে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২৪ জানুয়ারি ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম চলাকালে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চলবে বলে যে আদেশ দেওয়া হয়, এর আইনি ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ মামলার আইনগত এবং আইন-আদালত বহির্ভূত বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে সোমবার প্রকাশ্য আদালতে দীর্ঘ সময় ধরে বিতর্ক চলে।

রাষ্ট্রপক্ষ এ আদেশকে আইনসম্মত বললেও আসামিপক্ষ তা মানতে নারাজ। আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে চান তাঁরা।

কারাগারে থাকা খালেদা পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে এ মামলার শুনানিতে হাজির না হওয়ায় গত ২০ সেপ্টেম্বর আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০-এ ধারায় তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চলবে বলে আদেশ দেন পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান।

এদিকে ‘ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায়’ এবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন এ মামলার দুই আসামি।

এরা হলেন বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এই মামলার প্রধান আসামি।

সোমবার তাঁদের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ও মো. আক্তারুজ্জামান ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামানের প্রতি অনাস্থার কথা জানিয়ে লিখিত আবেদন করেন।

যে যুক্তিতে বিতর্ক

আসামিপক্ষ বলছে, যেহেতু খালেদা জিয়া এই আদালতের হাজিরা পরোয়ানার অধীনে কারাগারেই রয়েছেন। তাই আদালতেরই দায়িত্ব তাঁকে উপস্থিত করানো। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় আদালত তা করতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে আদালতের উচিত খালেদা জিয়ার যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য আদেশ দেওয়া। অথচ সেটা না করে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারের আদেশ দিতে পারেন না আদালত।

এ ছাড়া আসামিপক্ষ বলছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫৩ ও ২০৫ ধারার বিধান অনুযায়ী ৫৪০-এ ধারায় (আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার) আবেদন কেবলমাত্র আসামিপক্ষ করতে পারে। অথচ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের আদেশটি দেওয়া হয়। তাই এটি বিধিসম্মত হয়নি।

এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানান, “তাঁরা আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করতে চান। তাই বিচারিক আদালতের কার্যক্রম ২০ কার্যদিবস মুলতবি রাখার আবেদন জানিয়েছেন। এর মধ্যে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত নিয়ে আসবে আসামিপক্ষ।

এই মুলতবি আবেদনের বিষয়ে মঙ্গলবার সিদ্ধান্ত জানাবে আদালত।

আদালতের প্রতি অনাস্থা

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার শুনানিতে দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক চলাকালে আসামি জিয়াউল হক মুন্না তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের প্রতি অনাস্থা জানান। আবেদন গ্রহণের পর আদালত জামিন বাতিল করে তাঁকে কারাগারে পাঠান।

অনাস্থার প্রশ্নে অবশ্য আরেক আসামি মনিরুল ইসলাম তাঁর আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপ থাকেন।

এ আবেদনের পর আদালত মামলার শুনানির জন্য মঙ্গলবার দিন ঠিক করেছেন। পাশাপাশি আসামি জিয়াউল ইসলামের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়।

তাঁর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বেনারকে জানান, “আমরা আদালতকে বলেছি, এ মামলার প্রধান আসামি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আদালত হাজির না করা হলে এ মামলার কার্যক্রম চলতে পারে না। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলার আদেশ আইনসংগত হবে না। এ আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না।”

“এই আদালত প্রকাশ্য আদালত নন। এ আদালতের প্রতি আস্থা না থাকায় আমরা মামলাটি অন্য আদালতে হস্তান্তর চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করব। আর এ জন্য ২০ কার্যদিবস শুনানি মুলতবি চাওয়া হয়,” বলেন তিনি।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বেনারকে বলেন, “গতকাল আসামি পক্ষ যুক্তিতর্ক শুরু করেছিল। আজও জিয়াউল ইসলাম ও মনিরুল ইসলামের পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল। অথচ আজ তারা আদালতের প্রতি অনাস্থা এনেছে। তাদের স্ববিরোধী অবস্থান।”

তিনি বলেন, “তারা চায় এটা ষড়যন্ত্রের মধ্যে রাখতে। মামলা কার্যক্রম পরিচালনা না করতে।

“তবে আগামী শুনানিতে যদি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসে তাহলে আশা করি রায়ের দিন ধার্য করবেন আদালত। কারণ, মূল আইনে যুক্তিতর্ক করতে হবে—এমন বিধান নেই,” বলেন মোশাররফ হোসেন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে বিচারিক আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডাদেশ দেন। এরপর থেকে ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়া ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।

সোমবার শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার আদেশ চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনে তিনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এই মামলার কার্যক্রম মুলতবি চাওয়া হয় বলে বেনারকে জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া।

তিনি বলেন, “খালেদা জিয়া অসুস্থ সত্ত্বেও বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার অনুমতি দেননি। এই মুহূর্তে তাঁর সুস্থতা ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না আমরা।”

জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কমিশনের উপপরিচালক হারুন-অর-রশীদ আদালতে খালেদা জিয়া, তাঁর সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী এবং হারিছের তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠন করে আদালত। হারিছ চৌধুরী পলাতক রয়েছেন।

চিকিৎসা নিয়ে খালেদার রিটের শুনানি মঙ্গলবার

এদিকে কারা অন্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের শুনানি মঙ্গলবার ধার্য করেছে উচ্চ আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে সোমবার এই দিন ধার্য করেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

আসামিপক্ষের আইনজীবী কায়সার কামাল বেনারকে বলেন, “আবেদনটি শুনানির জন্য কার্য তালিকার ৩০ নম্বরে ছিল। রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রিটটি শুনানির জন্য মঙ্গলবার দিন ধার্য করেন।”

ইউনাইটেড বা বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে নির্দেশনা চেয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর রিট আবেদনটি করেন খালেদা জিয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।