আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিচার পেলেন খাদিজা, আসামির যাবজ্জীবন জেল

জেসমিন পাপড়ি
2017.03.08
ঢাকা
রায় ঘোষণার পর স্বজনদের সঙ্গে খাদিজা। রায় ঘোষণার পর স্বজনদের সঙ্গে খাদিজা। মার্চ ০৮, ২০১৭।
স্টার মেইল

বহুল আলোচিত সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে হত্যা চেষ্টার দায়ে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশের একটি আদালত।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একজন নারী নিপীড়ককে দেওয়া এই শাস্তি নারীর সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় গত বছরের ৩ অক্টোবর পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পথে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বদরুল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খাদিজার ওপর হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ ঘটনাস্থল থেকে বদরুলকে ধরে পুলিশে দেয়। পরদিন বদরুলকে একমাত্র আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস। পরে বদরুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খাদিজার মাথার খুলি ভেদ করে মস্তিষ্কও জখম হয়। প্রায় চার মাসের দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন খাদিজা।

ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস পাঁচ দিনের মাথায় মামলাটির বিচার কাজ সম্পন্ন হওয়াকে বিচার বিভাগের অন্যতম সাফল্য হিসেবে দেখছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তবে আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে আসামি বের হয়ে যাওয়ার শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তাঁরা।

রায়ের পর আসামি বদরুলকে কারাগারে নেওয়া হয়। মার্চ ০৮, ২০১৭।
রায়ের পর আসামি বদরুলকে কারাগারে নেওয়া হয়। মার্চ ০৮, ২০১৭।
ছবি: নিউজরুম ফটো
এদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বর্বর হামলার শিকার খাদিজা। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বেনারকে বলেন, “এই রায়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি আমার পড়াশোনায় শেষ করে নিজের স্বপ্নপূরণ করতে চাই।’

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমার চাওয়া আর কেউ যেন আমার মতো এমন পরিস্থিতির শিকার না হয়। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।”

মামলার বাদী খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস বেনারকে বলেন, “এই রায় যেন উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে এবং দ্রুত কার্যকর হয়।”

আসামির উপস্থিতিতে বুধবার সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আদালত চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করে। রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি আসামি বদরুলকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।

নারীরা এখনো অরক্ষিত: আদালত

আলোচিত মামলাটির রায়ে আদালতে বলেছে, খাদিজার ওপর এমন নৃশংস হামলা প্রমাণ করে নারীরা কতটা অরক্ষিত। রায়ে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করাতে বলা হয়েছে।

বিচারক আকবর হোসেন মৃধা রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, “এ দেশে নারীরা এখন আর নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া কথিত অন্দরমহলের অবরোধবাসিনী নন। তবে এখনো অনেকটা অরক্ষিত। খাদিজার ঘটনা তারই প্রমাণ।”

আদালত জানায়, সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই নারীরা পদে পদে নিগৃহীত, নির্যাতিত, হত্যা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

রায়ে খাদিজাকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া কিংবদন্তি নারী উল্লেখ করে বিচারক বলেন, “প্রেমে প্রত্যাখ্যাত পাষণ্ডের চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত খাদিজা দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুর কাছে হেরে যায়নি। সে বিশ্ব নারী সমাজের প্রতিভূ, বিজয়িনী, প্রতিবাদিনী।”

দেশের অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য বলেও উল্লেখ করে আদালত।

রায়ে বলা হয়েছে, “মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা থাকতেই পারে। কিন্তু তার জন্য এ ধরনের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড কাম্য হতে পারে না।”

বিচারক বলেন, “আন্তর্জাতিক নারী দিবসে খাদিজাকে নৃশংস ও বর্বরোচিতভাবে কোপানোর অভিযোগে আসামি বদরুলের যথোপযুক্ত শাস্তি নারীদের সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।”

আপিল করবে আসামিপক্ষ

এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন আসামি বদরুলের আইনজীবী সাজ্জাদুর রহমান।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “বদরুল সুবিচার পাননি। রায়ের কপি পর্যালোচনা করে আমরা উচ্চ আদালতে আপিলে যাওয়ার কথা চিন্তা করছি।”

এদিকে রায় ঘোষণার পুরো সময় চুপচাপ থাকলেও আদালত ভবন থেকে বের হওয়ার সময় আসামি বদরুল বলতে শুরু করেন, “জন্ম বাংলায়, মরব বাংলায়, এখানেই শেষ নয়। জয় বাংলা...” এ অবস্থায় তাঁকে দ্রুত প্রিজন ভ্যানে তুলে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ।

অন্যান্য মামলার অগ্রগতি কত দূর?

এদিকে খাদিজাকে হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আসামিরা বের হয়ে যেতে পারে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনায় অন্যান্য আলোচিত মামলাগুলোর অগ্রগতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন “অতি দ্রুত খাদিজার মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হলো। এর জন্য আমরা অবশ্যই সন্তুষ্ট। তবে অনেক সময় রাজনৈতিকভাবেই আসামিদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়। অনেক বছর পর গোপনে তারা বের হয়ে যায়। এমন শঙ্কা এই মামলার ক্ষেত্রেও রয়েছে।”

নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে এই রায় প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে এলিনা খান বলেন, “তাই যদি পড়ত, তাহলে একটার পর একটা নারী নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যার ঘটনা ঘটতো না। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে অন্তত ৮৫ শতাংশ ঘটনার বিচার ত্বরান্বিত করা জরুরি।”

এ সময় তিনি আরও বলেন, “খাদিজা বিচার পেলেও কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় খুন হওয়া কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর হত্যার বিচার পায়নি তাঁর পরিবার। এমন অসংখ্য মামলার অগ্রগতি নেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।