খালেদা জিয়ার মুক্তি: বিএনপি ও সরকারের মধ্যে হঠাৎ আলোচনা
2019.10.02
ঢাকা

গুরুতর অসুস্থ কারারুদ্ধ খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির ব্যাপারে তাঁর দল বিএনপি ও সরকারের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত মঙ্গল ও বুধবার বিএনপির সাংসদ, খালেদা জিয়া এবং সরকারি দলের নেতাদের মধ্যে এ বিষয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, জামিনে বড় বাধা সরকার। তাই সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষ নমনীয় হলে খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেতে পারেন।
মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন তাঁর দলের তিন সাংসদ। এরপর তাঁরা সাংবাদিকদের জানান, জামিন পেলে বিএনপি প্রধান বিদেশ যাবেন।
বুধবার দুপুরে পুনরায় দলীয় চার সাংসদ খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে জানান, খালেদা জিয়া ‘মারাত্মক’ অসুস্থ। বিএনপি সাংসদ হারুনুর রশীদ বুধবার দুপুরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে সচিবালয়ে তাঁর দপ্তরে দেখা করে জামিন দিয়ে বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানান। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার জন্য ওবায়দুল কাদেরকে অনুরোধ করেন।
জবাবে ওবায়দুল কাদের জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা জানান, খালেদা জিয়া কৌশলগত কারণে বিদেশ যেতে রাজি হতে পারেন। কৌশলটি হলো, যে উপায়েই হোক জেল থেকে বের হওয়া।
জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে দুর্নীতির যে দুটি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ১৭ বছর কারাদণ্ড হয়েছে, সে দুটি মামলায় তাঁর জামিন আবেদন হাইকোর্টে নাকচ হয়েছে। এখন তা আপিল বিভাগে যাবে। নতুন করে জামিনের আবেদন নিয়ে আপিল বিভাগে যাওয়ার আগে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় বিএনপি।
হঠাৎ আলোচনায় খালেদা জিয়া
মঙ্গলবার অনেকটা হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে যান বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ এমপি, সাবেক মন্ত্রী উকিল আব্দুস সাত্তার এমপি এবং আমিনুল ইসলাম এমপি।
হারুনুর রশীদ বেনারকে বলেন, “আমরা তিন সংসদ-সদস্য মঙ্গলবার আমাদের দলীয় প্রধান দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেছি। আমরা তাঁর সাথে কথা বলেছি, দেখেছি উনার স্বাস্থ্যের অবস্থা মারাত্মক খারাপ হয়ে গেছে। উনি সেখানে ভালো, তাঁর পছন্দমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না।”
তিনি বলেন, “উনি জামিন পেলে অবশ্যই উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন।”
হারুনুর রশীদ বলেন, “আমি আজ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে সাক্ষাৎ করে বেগম খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছি। আমি বলেছি, উনি যেন প্রধানমন্ত্রীকে এব্যাপারে জানান।”
হারুনুর রশীদের সাথে সাক্ষাতের পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “উনি আমার সাথে দেখা করে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসকেরা দাবি জানিয়েছেন। জামিনের দাবি জানিয়েছেন। আমি বলেছি আমি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁদের দাবি সম্পর্কে অবহিত করব।”
তিনি বলেন, “তবে জামিনের বিষয়টি তো আদালতের হাতে, সরকারের হাতে নেই। আদালত তাঁকে সাজা দিয়েছে। তাঁর জামিনের ব্যাপারে সরকারের কিছু করার নেই।”
বুধবার সাংসদ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের নেতৃত্বে চার সাংসদ খালেদা জিয়ার সাথে তাঁর প্রিজন সেলে দেখা করেন।
সেখান থেকে বেরিয়ে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ম্যাডামের সাথে দেখা করেছি। উনার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। উনি ঠিকমতো চলতে পারছেন না। উনার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমরা সরকারের কাছে তাঁর জামিন দাবি করছি।”
তিনি বলেন, “সরকারের ইন্টারভেনশন ছাড়া খালেদা জিয়ার জামিন হবে না। তাই আমরা সরকারের কাছে তাঁর জামিনের আহ্বান জানাই।”
বিএনপি সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, “ম্যাডাম আমাদের বলেছেন, উনি কিছুই করেননি। তাই, জামিন উনার অধিকার। তাঁকে রাজনৈতিক নির্দেশে সাজা দেয়া হয়েছে।”
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হন তিনি।
প্রথমে তাঁকে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরোনো জেলখানায় রাখা হয়। পরে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আনা হয়। উনি এখন সেখানে রয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “এর আগেও খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া জামিন পেলে বিদেশ যেতে রাজি আছেন এমন কথা আমরা আগে শুনিনি। তার অর্থ হলো, খালেদা জিয়া হয়তো বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে আগের চেয়ে নমনীয় হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “আসলে সত্য বলতে গেলে, খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করার চিন্তা কয়জন করেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক আলোচনায় নেই। বিএনপি এখন বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন-সর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে।”
ড. নিজাম বলেন, “আবার খালেদা জিয়া, আমার মনে হয়, জেলে থাকতে চান না। দলের কার্যক্রমে উনি সন্তুষ্ট নন। আবার ওনার বয়স হয়েছে। ৭৫/৭৬ বছর বয়সে জেলে থাকাটা সত্যিই কষ্টকর। এ কারণে হয়তো জেলের বাইরে আসতে চান তিনি। উনি হয়তো সরকারের সাথে কোনো সমঝোতায় যেতে চান, যদিও এব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলার সময় আসেনি।”
তিনি বলেন, “বিএনপি নেতা কর্মীরা খালেদা জিয়াকে কারাগারের বাইরে দেখতে চান। এ কারণে কৌশলগত কারণে খালেদা জিয়া বিদেশ যেতে রাজি হতে পারেন।”
ড. নিজাম বলেন, খালেদা জিয়া বিদেশে গেলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। কারণ সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার আপসহীন নেত্রীর পরিচয়টি আর থাকবে না।
তিনি বলেন, তবে সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে রাজি হলে বিএনপি প্রচার করবে যে, সরকার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়েছে।
বিএনপির সাবেক স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “বিএনপির রাজনীতি বলে কিছু নেই। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত। উনার হাতে রাজনীতি নেই। উনার বিদেশ যাওয়া নিয়ে যা হচ্ছে সেগুলো রাজনৈতিক খেলা মাত্র।”
তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না সরকার তাঁকে কোনো বিশেষ শর্ত ছাড়া বিদেশ যেতে অনুমতি দেবে। তবে তাঁর বিদেশে যাওয়া নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনাটুকুই বিএনপির লাভ। আর কিছু নয়। কারণ তারা রাজনীতির মাঠে নেই।”