মালিকপক্ষে আইন অমান্য প্রবণতা, গেলো বছর কর্মক্ষেত্রে নিহত ১২৪০ শ্রমিক

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.01.05
এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন অধিকাংশ শ্রমিক। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন অধিকাংশ শ্রমিক। জুলাই ০৭, ২০১৬।
স্টার মেইল

২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২৪০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের প্রাণহানির সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কলকারখানাগুলো নিরাপত্তার শর্ত মানছে না। মালিকের গাফিলতিতে দুর্ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। প্রতিবেদনে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রম আইনে শ্রমিকের প্রাণহানি ও পঙ্গুত্বের জন্য মালিকপক্ষের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা তা এড়িয়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি আইন ও সালিস কেন্দ্র বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৬ পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি এনভায়রনমেন্ট (ওশি) ফাউন্ডেশনকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে মোট ১ হাজার ২৪০ জন শ্রমিক নিহত হন।

ওশির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৯৫১, ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৬৫।

যেসব খাতে শ্রমিকের মৃত্যু

গত বছর সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা গেছেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কাজ করতে যাওয়ার সময়। এই সংখ্যাটি ছিল ৪৮৬, এর বাইরে নির্মাণ খাতে ১৪৭ জন, তৈরি পোশাক খাতে ৮৮ জন, কৃষি খাতে ৮৭ জন, দিন মজুর ৬৯ জন, ট্যাম্পাকো প্লাস্টিক অ্যান্ড ফয়েলস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৭ জন, গৃহকর্মী ৩৪ জন, জাহাজ ভাঙা খাতে ২৩ জন, মাছ ধরার সময় ৪৪ জন এবং বিভিন্ন খাতে কর্মরত অবস্থায় ২১৩ জন শ্রমিক মারা গেছেন।

“ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হলেও নির্মাণ খাতে শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তার মানে নির্মাণ খাতে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি,” বেনারকে বলেন বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস এর নির্বাহী প্রধান সেকেন্দার আলী মিনা।

প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে ম্যানুফ্যাকচারিং খাত বলতে বোঝানো হয়েছে, জাহাজ ভাঙা শিল্প, চাল কল, তৈরি পোশাক খাত, ইট ভাটা, স্টিল বা রি-রোলিং মিলস। আর নির্মাণ খাতের আওতায় আছে আবাসিক বা অনাবাসিক ভবন, সেতু ও অন্যান্য অবকাঠামো।

নির্মাণ শ্রমিকদের বড় অংশ ওপর থেকে পড়ে গিয়ে বা বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। এর বাইরে তাঁদের শব্দ দূষণ, ধুলা, অপর্যাপ্ত আলো, খাবার পানির সংকটের ভেতর কাজ করতে হয়। ফলে তাঁরা রোগেও ভোগেন বেশি।

নির্মাণ খাতে এত প্রাণহানির কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহমেদ বেনারকে বলেন, “ভবন নির্মাণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না। সরকারিভাবে ভবন, সেতু ও বড় বড় স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রেও আইন না মানার প্রবণতা লক্ষণীয়।

এ বছর একটি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয় গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকার ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামের একটি প্লাস্টিক ও প্যাকেজিং কারখানায়। এর দুই মাসের মাথায় আশুলিয়া জিরাবো এলাকায় অননুমোদিত গ্যাস লাইটার প্রস্তুতকারক ‘কালার ম্যাচ’ বিডি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন, ২১ জন অগ্নিদগ্ধ হন।

মালিকপক্ষ দায় নেন না

দুর্ঘটনার দায় মালিকপক্ষ নেন না। প্রভাবশালী হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্ত মালিকপক্ষকে ধরার চেষ্টাও সাধারণত করে না।

ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডে দুর্ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেন, তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। কিন্তু তাঁদের কেউই গ্রেপ্তার হয়নি।

ট্যাম্পাকোর স্থানীয় শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের টঙ্গী আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান হেলাল বলেন, “উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার পর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কারখানাটি মালিকপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এজাহারভুক্ত আসামিকে তারপরও কেউ খুঁজে পায়নি।”

কালার বিডি ম্যাক্স লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেও কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি।

ক্ষতিপূরণও মেলে না

বাংলাদেশের শ্রম আইনে সামান্য দুর্ঘটনা বা বিপজ্জনক দুর্ঘটনায় মহাপরিদর্শক, জেলা প্রশাসক, কলকারখানা পরিদর্শক, থানা বা শিল্প পুলিশকে জরুরি ভিত্তিতে মালিকপক্ষের জানানোর কথা। আহত শ্রমিকের চিকিৎসার পুরো খরচ, সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ও অসুস্থ অবস্থায় মজুরি দেওয়ার বিধান আছে।

“আইন অনুযায়ী কোনো শ্রমিক যদি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাজে যোগ দিতে না পারেন, তাহলে সরকারি কর্তৃপক্ষকে জানানোর বাধ্যবাধকতা আছে। মালিকপক্ষ নিয়ম জানেন না বা মানেন না,” বেনারকে জানান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জাকির হোসেন।

নির্মাণ খাতে শ্রমিকেরা নিহত বা আহত হলে সাধারণত ক্ষতিপূরণ পান না। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিক সরদারদের মাধ্যমে শ্রমিক সংগ্রহ করেন। শ্রমিক সরদার বা শ্রমিক কাউকে প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি নিয়োগ দেয় না। ফলে শ্রমিকের মৃত্যু হলে বা শ্রমিক আহত হলে তার দায় মালিকপক্ষ নেয় না।

মো. বাতেন মিয়া (৪৫) গত ২৭ মে দ্য পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে মাটির ১০ ফুট নিচে গ্যাস পাইপলাইনে কাজ করছিলেন। সেখানেই মাটিচাপা পড়েন। বাকি জীবন তাঁকে হুইলচেয়ারে কাটাতে হবে বলে জানিয়েছেন বাতেন মিয়ার ভাই নোমান মিয়া।

“আমার ভাই চিকিৎসা বাবদ মালিকপক্ষ থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছেন,” বেনারকে জানান নোমান মিয়া।

টঙ্গীর গোপালপুর হাজিবাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকেন টাম্পাকো ফয়েলস এর কর্মী মনোয়ার হোসেন। চারটি হাসপাতালে চিকিৎ​সা নিয়েছেন। মালিকপক্ষ মাত্র চার হাজার টাকা দিয়েছে। এরপর আর যোগাযোগ করেনি।

“আমরা একটি শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করেছি। সেখান থেকে নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহতদের সহযোগিতা করা হয়। তবে মালিকপক্ষ যেন আইন অনুযায়ী শ্রমিককে তাঁর প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন সে জন্য কাজ করা হচ্ছে,” বেনারকে জানান শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।