সৌদি সরকারের দুটি সিদ্ধান্তে প্রবাসীদের স্বস্তি ও উদ্বেগ
2017.01.23

বিদেশি শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ফি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সৌদি আরব। তবে তাদের পোষ্যদের (স্ত্রী-সন্তান ও অন্যদের) ওপর মাথাপিছু ফি আরোপ করায় সংকটে পড়তে যাচ্ছেন সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
সৌদি অর্থ মন্ত্রণালয় গত রবিবার জানিয়েছে, সেখানে কর্মরতদের রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনও ফি নির্ধারণ করা হচ্ছে না। সৌদির শূরা কাউন্সিল রেমিটেন্সের ওপর ৬ শতাংশ ফি আরোপ করা নিয়ে একটি প্রস্তাবনার ওপর আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়।
আরব নিউজ, আল আরবিয়া, সৌদি গেজেটসহ দেশটির বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই ফি নির্ধারণের প্রস্তাব নিয়ে খবর প্রচার করা হয়।
একইসঙ্গে স্বস্তি ও উদ্বেগ
ফি নির্ধারণ না করার খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছে সৌদি আরবে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তবে প্রবাসীদের পোষ্যদের ওপর উচ্চহারে ফি নির্ধারণ করায় তাঁরা নতুন চাপে পড়বেন।
সৌদি আরব এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। যদিও সেখানে এক ধরনের মন্দা চলছে।
রিয়াদে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক মাসুম খান জনসন বেনারকে বলেছেন, “ফি আরোপ না করায় আমাদের দুশ্চিন্তা কিছুটা কমল। তবে সৌদি সরকারের উচ্চমাত্রায় মাসিক ফি আরোপ করায় আমরা স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এ দেশে থাকতে পারব কিনা সন্দেহ।”
তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে দিতে হবে। এই ফি প্রতি বছর আরো ২ হাজার টাকা করে বাড়বে। এই বৃদ্ধি চলবে আগামী ৫ বছর। অর্থাৎ একজন চাকুরিজীবীকে পরিবারের প্রতি জনের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে। কারো স্ত্রী এবং দুই সন্তান থাকলে তাকে দিতে হবে মাসে ৩০ হাজার টাকা। এভাবে আয়ের বড় অংশ সরকারকে দিতেই হবে।”
মাসুম খান বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করতেন। সৌদি আরবে একটি স্কুলে শিশুদের ইংরেজি শেখানোর চাকরি নিয়ে রিয়াদে চলে যান।
অনলাইনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। আশা করেছিলাম সন্তান জন্মের পর স্ত্রী ও সন্তানকে সৌদি আরবে নিয়ে আসব। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হবে না। যা আয় করি তার একটা বড় অংশই সরকারের কাছে চলে যাবে।”
পরিবারের উপর দুই ধরনের ফি
গত ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত ২০১৭ সালের সৌদি বাজেটে প্রবাসীদের জন্য দুই ধরনের ফি আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এক ধরনের ফি আরোপ করা হবে প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের সংখ্যার উপর।
মূলত: সৌদি আরবে বসবাসরত প্রবাসীরা যেসব সেবা গ্রহণ করেন তার জন্য এই ফি দিতে হবে। ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে এটা কার্যকর হবে। ফি’র পরিমাণ প্রত্যেক বছর বাড়তে থাকবে। শুরুতে ১০০ রিয়াল হলেও প্রতি বছর বেড়ে ২০২০ সাল নাগাদ মাথাপিছু এই ফি দাঁড়াবে ৮০০ সৌদি রিয়াল পর্যন্ত।
তবে গৃহকর্মে সাহায্যকারী শ্রমিক যেমন ড্রাইভার এবং ক্লিনাররা এই ফি থেকে মুক্ত থাকবেন। এই ফি শুধু বাণিজ্যিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
সৌদির এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি বাসিন্দাই বিদেশি। তাদের অনেকেই কর দিতে হবে না বলে এবং ভালো বেতনের আশায় সেখানে গেছেন। কিন্তু তেলের দাম কমে যাওয়া এবং বাজেটের ঘাটতি কমাতে গত বছর একটি সংস্কার পরিকল্পনায় বিদেশি শ্রমিকদের ওপর আয়কর আরোপের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে, কমেছে রেমিটেন্স
গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন নাগরিকের। আগের বছরে (২০১৫) এ সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন। জনশক্তি রপ্তানির হার বাড়লেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ভাটা পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বনিম্ন ‘রেমিটেন্স’ এসেছে। ২০১২ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর ২০১৩ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে সেই রেমিটেন্স নেমে এসেছে ১৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে।
তবে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ প্রকৃত অর্থে খুব একটা কমেছে বলে মনে করেন না বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম। সোমবার বেনারকে তিনি বলেছেন, বিকাশ এবং হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসায় গত বছরের অফিসিয়াল রেকর্ডে রেমিটেন্স কম দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “রেমিটেন্স কমার কারণ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন। এটা বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠানো নিরুৎসাহিত করেছে।”
অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়লেও কমছে রেমিটেন্স। এর প্রধান কারণ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে।