অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ড ফান্ড: প্রক্রিয়া সহজ করার দাবি
2017.05.01
ঢাকা

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য কিছুটা নিয়ম–নীতি থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা নানা দিক থেকেই বঞ্চিত। এই পরিস্থিতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জন্য ভবিষ্য তহবিল বা প্রভিডেন্ড ফান্ড চালু করছে সরকার। তবে এই তহবিলের প্রক্রিয়া সহজতর করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এখন থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সকল কর্মী ‘কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড’ এর আওতাভুক্ত হবেন বলে গত রোববার এক অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু।
দিনমজুর শ্রমিকদের জন্য সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে শ্রমিক নেতা ও বিশ্লেষকেরা এই প্রক্রিয়াকে সহজতর করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ জাফরুল হাসান বেনারকে বলেন, “এটি নিঃসন্দেহে শ্রমিকদের জন্য নেওয়া দারুণ উদ্যোগ। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা সহজ না করলে এর সুফল শ্রমিকদের কাছে পৌঁছাবে না।”
দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠনের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে এসব খাতের শ্রমিকদের প্রকৃত শ্রমিক ঘোষণা করতে হবে, যাতে করে তারা সত্যিকার শ্রমিকের অধিকার ভোগ করতে পারে।”
যেভাবে বাস্তবায়ন হবে
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে এই প্রভিডেন্ড হবে মূলত: ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ বছর মেয়াদী। প্রাথমিকভাবে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে এই তহবিলের লেনদেন হবে। তবে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও এ হিসাব খোলার সুবিধা পাওয়া যাবে।
নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে শ্রমিক ও ফাউন্ডেশনের অংশ এবং সঞ্চয়ী প্রতিষ্ঠানের মুনাফাসহ জমাকৃত পুরো অর্থের ওপর ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হারে মুনাফা দেওয়া হবে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, একটি ক্যাশকার্ডের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শ্রমিকদের এই হিসাবের লেনদেন হবে।
তবে এই হিসাব খুলতে শ্রমিকদের পেশা প্রমাণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সনদপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের প্রতিস্বাক্ষর বা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যেকোনো দপ্তরের কর্মকর্তার প্রতিস্বাক্ষরও থাকতে হবে।
শ্রমিকেরা প্রতি মাসে একশ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত জমা করতে পারবেন। তাঁদের ভবিষ্যত চিন্তা করে এ তহবিলে অর্থ জমা রাখতে পারবেন নিয়োগকর্তারাও, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়।
শ্রমিকেরা মাসে দুইশ টাকা পর্যন্ত জমা করলে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনও সমপরিমাণ টাকা সেই হিসাবে জমা দেবে। তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা হারে জমার ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশন ২৫০ টাকা হারে অর্থ জমা করবে।
নির্দিষ্ট মেয়াদ পরে লাভসহ সেসব অর্থ ফেরত পাওয়ার পাশাপাশি হিসাবধারীরা নানা ধরনের অর্থিক সুবিধা পাবেন বলে জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার।
তিনি বেনারকে বলেন, “কোনো শ্রমিক মানসিক বা দৈহিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে কিংবা মারা গেলে তাঁর নমিনিকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে। হিসাব খোলার তিন বছর পর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা সহায়তাও পাবেন তারা। গর্ভবতী হলে (দুইবার পর্যন্ত) নারী সদস্য ২৫ হাজার টাকা করে পাবেন।”
প্রসঙ্গত, কৃষি, মৎস, পোল্ট্রি ও ফিশারিজ, নির্মাণ, মাটিকাটা, গৃহকর্ম, নিরাপত্তা, সেলুন, বেকারি, দোকানপাট, ফোন-ফ্যাক্স-কম্পিউটার, জুতাশিল্প এবং হাট ও ঘাট খাতের শ্রমিক, কর্মচারী ও কারিগররা এর আওতায় আসবেন। পাশাপাশি, কামার, কুমার, তাঁতি, কাঠমিস্ত্রি, রং ও পলিশ মিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বার, ফেরিওয়ালা, দর্জি, নৌকার মাঝি, ছাতার কারিগর, রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি চালক প্রভৃতি আত্মকর্মসংস্থান খাতের শ্রমিকেরও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক হিসেবে এই তহবিল সুবিধা পাবেন।
ভবিষ্য তহবিল নীতিমালাটি বর্তমানে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রম সচিব।
শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি
বাংলাদেশে শ্রমিকদের বেতন এখনো অনেক কম জানিয়ে সকল সেক্টরের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবি তুলেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিকদের জন্য আলাদা মজুরি কমিশন গঠনের দাবিও জানিয়েছে তাঁরা।
মে দিবস উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গতকাল এই দাবি তোলা হয়।
শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ১৮ হাজার করার দাবি জানান বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এ এ এম ফয়েজ হোসেন।
অপর এক অনুষ্ঠানে শ্রমিকদের জন্য মজুরি কমিশন গঠনের দাবি জানান ওয়ার্কার্স পার্টির চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন খালেদ সেলিম।
তিনি বলেন “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ার পাশাপাশি আলাদা পে-কমিশন করা হয়েছে। অথচ যেসব শ্রমিকেরা নিজেদের শ্রম-ঘাম দিয়ে এদেশকে গড়ছে তাদের জন্য এখনো কোনো মজুরি কমিশন গঠন করা হয়নি।”
কর্মঘণ্টার বেশি কাজ করে ৮০ শতাংশ শ্রমিক
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণা বলছে, দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ শ্রমিককে শ্রম আইনে নির্ধারিত দৈনিক আট ঘণ্টার চেয়ে বেশি সময় কাজ করানো হয়।
মূলত: পরিবহনকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিক, রি-রোলিং মিলের শ্রমিক এবং হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শ্রমিকদের নিয়ে পরিচালিত জরিপটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত রোববার।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত হিসেবে পরিবহন খাতকে দেখানো হয়েছে এ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, শতভাগ পরিবহন শ্রমিকই দিনে আট ঘণ্টার চেয়ে বেশি কাজ করেন। এ কারণে তাঁরা দুর্ঘটনার শিকারও হন বেশি।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, কর্মঘণ্টার দিক থেকে পরিবহন শ্রমিকদের পরেই রয়েছে রি-রোলিং খাতের শ্রমিকরা। প্রায় ৯২ শতাংশ রি-রোলিং, ৯৮ শতাংশ হোটেল, ৮০ শতাংশ নিরাপত্তা কর্মী এবং ৪২ শতাংশ হাসপাতাল শ্রমিক দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করে থাকেন। সাপ্তাহিক ছুটির ক্ষেত্রেও তারা নানাভাবে বঞ্চিত।
এ বছরের প্রথম দুই মাসে ঢাকা এবং এর আশপাশের কয়েকটি এলাকায় এই পাঁচ খাতের ৫০ জন করে শ্রমিকের ওপর এ গবেষণা চালায় বিলস।