ট্রেড ইউনিয়ন শর্ত শিথিল করে শ্রম আইন পাশ
2018.10.24
ঢাকা
শিল্প কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত শিথিল করে বুধবার জাতীয় সংসদে শ্রম সংশোধনী আইন পাশ হয়েছে। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বিলটি পাশ করার আহ্বান জানালে কণ্ঠভোটে বিলটি পাশ হয়।
পাশ হওয়া আইন অনুযায়ী কোনো কারখানার মোট শ্রমিকের শতকরা ২০ ভাগ শ্রমিক একত্রিত হলে ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে।
বর্তমানে কার্যকর ২০০৬ সালে পাশ হওয়া শ্রম আইনে এই অনুপাত ছিল শতকরা ৩০ ভাগ।
বুধবার শ্রম আইন সংশোধন বিলটি পাশের ফলে ছোট বড় মিলিয়ে শ্রম আইন-২০০৬ এর মোট ৪৭টি ধারা সংশোধন করা হলো।
তবে, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও শ্রম আইনজীবীরা বলছেন, বিলটিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অবাধ অধিকার দেওয়া হয়নি।
প্রবীণ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “আমরা যেভাবে আইনটি পাশ করা হচ্ছে সেটির বিরোধী। কারণ এই আইন শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অবাধ সুযোগ দিচ্ছে না। আমাদের দাবি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে।”
ডা. খান বলেন, এই আইনে কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টার বেশি করা হয়েছে। এটিও আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী।
তিনি বলেন, সংশোধিত শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ মাত্র দুই লাখ টাকা। সরকার বলছে তারা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে। কিন্তু দুই লাখ টাকা কি খুব বেশি টাকা? এভাবে ক্ষতিপূরণের টাকা নির্ধারণ ঠিক নয়।
তাঁর মতে, বাংলাদেশে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে সেটা মালিক-শ্রমিক সরকার সকলের জন্যই ভালো হতো। শিল্প কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেতো।
তাঁর মতে বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। তাই তারা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে চায় না।
তিনি বলেন, কোথাও শ্রমিক অসন্তোষ হলে মালিক ও সরকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সাথে বসে সমস্যা সমাধান করতে পারবে। ট্রেড ইউনিয়ন না থাকলে মালিকদেরই সমস্যা বাড়বে।
শ্রম বিষয়ক আইনজীবী ড. উত্তম কুমার দাস বেনারকে বলেন, প্রথমত আন্তর্জাতিক শ্রম প্রতিষ্ঠান আইএলও এর বিধান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন হতে হবে অবাধ। কোনো হার নির্ধারণ করা যাবে না। তবে, শতকরা ৩০ হার থেকে ২০ হারে নামিয়ে আনা একটি বড় অগ্রগতি বলা যায়।
তিনি বলেন, অনেক সময় ট্রেড ইউনিয়ন করার কারণে শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। পাশ হওয়া শ্রম আইনে এ ধরনের অ্যান্টি-ট্রেড ইউনিয়ন ডিসক্রিমিনেশন থেকে শ্রমিকদের রক্ষার জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।
ড. উত্তম কুমার বলেন, বাংলাদেশের ফ্যাক্টরির মালিকদের ট্রেড ইউনিয়নের ব্যাপারে একটা ভয় কাজ করে। কারণ, শ্রমিক ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে নয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে অন্যান্য ক্ষেত্রের লোকেরা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী পাঁচটি শ্রমিক সংগঠন মিলে একটি শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করতে পারে। আর এই ফেডারেশনের নেতারা হলেন কেউ মন্ত্রী, কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ সাংবাদিক।
ড. উত্তম আরো বলেন, বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে ৫০টি শ্রমিক ফেডারেশন আছে। এখন মালিকেরা যদি কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চায় তাহলে ৫০টি ফেডারেশনের সাথে কথা বলতে হবে। এটি সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, পাশ হওয়া আইনটিতে শ্রমিকদের ব্যাপারে কিছু কিছু নেতিবাচক বিষয় রয়েছে।
তিনি যোগ করেন, “নতুন আইনে মাতৃত্বকালীন ছুটিকে ‘সুবিধা’ বলা হয়েছে। এই আইন পাশের ফলে শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি আর অধিকার থাকল না।”
ড. উত্তম কুমার বলেন, আইএলও এর বিধান অনুযায়ী একজন শ্রমিকের খাবার খাওয়া ও অন্যান্য সময়সহ কর্মঘণ্টা মোট আট ঘণ্টা হতে হবে। কিন্তু নতুন শ্রম আইন অনুযায়ী, খাদ্য গ্রহণ ও অন্যান্য বিরতি ছাড়া একজন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা মোট দশ ঘণ্টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যাবে।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের সুবিধার ক্ষেত্রে চা শ্রমিকদের আলাদা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই আইন অনুযায়ী, অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকেরা অবসরের সময় যেসব সুবিধা পাবে চা শ্রমিকেরা সেগুলো পাবে না।
ড. উত্তম বলেন, আইন কখনো বৈষম্যমূলক হতে পারে না।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বেনারকে বলেন, নতুন আইনের মাধ্যমে আমরা ২০০৬ সালে পাশ হওয়া শ্রম আইনের সেসব ধারাগুলোই সংশোধন করার প্রস্তাব করেছি যেগুলোর ব্যাপারে শ্রমিক, মালিক ও সরকার একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, আইএলও এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রম আইনের ব্যাপারে যেসব মতামত দিয়েছে সেগুলো সংযোজন করা হয়েছে। যেসব বিষয়ে তিন পক্ষ এক হতে পারেনি সেগুলো বিলে আনা হয়নি।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালের আইনে একজন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা বিরতিসহ দশ ঘণ্টা করার কথা বলা ছিল। কিন্তু মালিকেরা বিরতির বিষয়টি দেখিয়ে ইচ্ছামতো কর্মঘন্টা বৃদ্ধি করত। সেকারণে আমরা বিরতি ছাড়া কর্মঘন্টা দশ ঘন্টা বৃদ্ধির কথা বলেছি।