জুলহাজ ও তনয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত এক জঙ্গি গ্রেপ্তার
2019.01.16
ঢাকা

বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আল কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য ওই ব্যক্তির নাম আসাদুল্লাহ।
বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম এই তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান আসাদুল্লাহকে (২৫) মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আসাদুল্লাহর সাংগঠনিক নাম ফখরুল ওরফে ফয়সাল ওরফে জাকির ওরফে সাদিক। মনিরুল জানান, এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হলেন, আসাদুল্লাহ, আরাফাত, জুবায়ের ও সায়মন।
“গোপন তথ্যের ভিত্তিতে টঙ্গী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডিএমপি’র কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা জুলহাস-তনয় হত্যা মামলার অন্যতম মূল হোতা আসাদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে। এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিল আসাদুল্লাহ,” মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন।
তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালে উত্তর বাড্ডার সাঁতারকুলে পুলিশের ওপর হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিল এই আসাদুল্লাহ। আনসার আল ইসলামে যোগ দেওয়ার আগে সে যশোরের নওয়াপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিল।
জোড়া খুনের একদিনের মাথায় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আনসার আল ইসলাম বিবৃতি দেয়। প্রথমে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেয় ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগ। পরে কাউন্টার টেররিজম (সিটি) বিভাগ। তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডের ১৩ জনের সম্পৃক্ততার কথা জানায় পুলিশ। তবে তিন বছর পরও সব আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি তারা।
মনিরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ তদন্ত ও গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে তাঁরা নিশ্চিত ওই দিন ঘটনাস্থলে ছিলেন সাতজন। তাদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। বাকি দুজন ছিলেন ‘ইনটেল’ গ্রুপের সদস্য।
পুলিশের বর্ণনামতে, ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল টঙ্গী থেকে আসাদুল্লাহ বাসে করে ঢাকায় আসেন। সাতজনের ওই দলের পাঁচজন জুলহাজদের বাড়িতে ভুয়া পার্সেল হাতে ঢোকেন। ছয়তলা ভবনের দোতলায় যান তিনজন। অপর দুজন দারোয়ান পারভেজ মোল্লাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে তাঁকে আটকে রাখেন। ওই দুজনের একজন ছিলেন আসাদুল্লাহ।
আসাদুল্লাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, আসাদ আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রশিক্ষক। বাড্ডা, আশকোনা, গাজীপুরের বিভিন্ন আস্তানায় বাসা ভাড়া নেয়ার পদ্ধতি, নিরাপত্তার বিষয়, ডে-অ্যাম্বুশ, সম্মানজনক মৃত্যু, চাপাতি চালানো, পিস্তল চালানো, টার্গেটকে হত্যা করা, এলাকায় রেকি করা এবং হত্যার সময় ও স্থান নির্ধারণ করার পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে।
কলাবাগানে জুলহাজ-তনয়কে কুপিয়ে হত্যা ছাড়াও আসামিরা দারোয়ান পারভেজ মোল্লাকে আক্রমণ করেন। কাছেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা উপসহকারী পরিদর্শক মমতাজ একজনের কাছ থেকে একটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। ব্যাগের ভেতর থেকে পিস্তল, দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মুঠোফোন পাওয়া যায়।
ঘটনার রাতেই জুলহাজ মান্নানের ভাই মিনহাজ মান্নান অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে কলাবাগান থানায় মামলা করেন। এএসআই মমতাজের ওপর হামলা ও ব্যাগ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় কলাবাগান থানায় উপপরিদর্শক শামীম আহমেদ আরেকটি মামলা করেন।
আসামি গ্রেপ্তার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে জুলহাস মান্নানের ভাই ও মামলার বাদি মিনহাজ মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি কথা বলতে চাননি।
“দেখুন, আমি কিছু বলতে চাই না। লিখে দিন, আমি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি,” মিনহাজ মান্নান বলেন।
জুলহাজের পারিবারিক সূত্রগুলো বলছে, আসামি গ্রেপ্তারে ধীর গতি, বিচার শুরু না হওয়ায় পরিবারটি হতাশ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া পুলিশ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে না।
তিন দিনের রিমান্ডে, অভিযোগপত্র ‘খুব দ্রুতই’
বুধবার দুপুরের দিকে আসাদুল্লাহকে আদালতে উপস্থিত করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদ শুনানি শেষে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে জুলহাস মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও, মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি পুলিশ। আগামী ২২ জানুয়ারি আবারও আদালতে এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মনিরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, খুব দ্রুতই তাঁরা এই মামলার অভিযোগপত্র দিতে চান।
মেজর (বরখাস্তকৃত) জিয়াউল হক কোথায়
জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরেক আসামি গ্রেপ্তারের পর আবারও প্রশ্ন উঠেছে আনসার আল ইসলামের বরখাস্তকৃত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হকের অবস্থান নিয়ে। তিনি কোথায় আছেন সে সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে অন্ধকারে।
মঙ্গলবার টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার আসাদুল্লাহ পুলিশকে জানান, তাঁরা বাড্ডার সাঁতারকুলের একটি বাসায় থাকতেন।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এই বাড়িতে তাঁরা অভিযান চালান। অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করে জঙ্গিরা এবং পুলিশ পরিদর্শক বাহাউদ্দীন ওই ঘটনায় মারাত্মক আহত হন।
পুলিশের ধারণা সাঁতারকুলের ওই বাড়িতে জিয়াউল হক ছিলেন, একটুর জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এরপর তিনি উত্তরখানে ছিলেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
গত বছরের ১৭ জুলাই জুলহাস মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যায় গ্রেপ্তার জুবায়ের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই জবানবন্দিতে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে তাঁর বাসায় ২০১৭ সালের প্রথম ভাগে এসে উঠেছিলেন জিয়া।
এর আগে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট জিয়াউল হককে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। কিন্তু জিয়াউল অধরাই থেকে গেছেন। তবে তাঁকে গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও জনসংযোগ) সোহেল রানা।
“আসামি গ্রেপ্তারে পুরস্কার ঘোষণা হচ্ছে একটি মাধ্যম। এর বাইরে বাকি যা যা উদ্যোগ পুলিশের নেওয়া দরকার, তার সবই নেওয়া হয়েছে,” সোহেল রানা বেনারনিউজকে বলেন।