সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ ও তনয় হত্যার এক বছর, তদন্তে অগ্রগতি নেই
2017.04.24
ঢাকা
ঢাকার কলাবাগানে মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের তদন্তকাজ একরকম থমকে আছে। পুলিশ বলছে, ওই হত্যাকাণ্ডে পাঁচ থেকে সাতজন অংশগ্রহণ করে। কিন্তু গতকাল সোমবার পর্যন্ত তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত বছরের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের নিজ বাসায় চাপাতির কোপে নিহত হন জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়। হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট’ (একিউআইএস) এর দায় স্বীকার করে। বাংলাদেশে সংগঠনটির ভাবাদর্শ অনুসরণকারী দল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল বলে জানায় পুলিশ।
জুলহাজ মান্নান সমকামীদের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রথম ম্যাগাজিন রূপবানের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সহযোগী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়। এই দুজনের মৃত্যুর পর সমকামীদের অধিকার আদায়ের সামাজিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে।
মঙ্গলবার জুলহাজ ও তনয়ের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বিবৃতি দিয়েছেন। এতে তিনি জুলহাজকে প্রেরণাদায়ী বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর ভাষায়, জুলহাজ মানবাধিকার রক্ষায় প্রাণ দিয়েছেন। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস সেই মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাসের আমরা তার অন্য একটি পরিবার। আমরা তার প্রচেষ্টাকে- আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। সেই প্রচেষ্টা হলো মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যেন তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়,” বিবৃতিতে মার্শা বলেন।
এর আগে হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জুলহাজ মান্নানের পরিবারের প্রতি শোক জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বিচারের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। মৃত্যুর আগে জুলহাজ ইউএসএআইডিতে কাজ করেছেন প্রায় এক দশক।
পুলিশের কাছে অগ্রগতি নেই
আগামী ৮ মে জুলহাস মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে আরও নয়বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ পড়ে। প্রতিবারই পুলিশ তারিখ পেছানোর অনুরোধ করেছে।
মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবির তদন্ত তদারক কর্মকর্তা রাজীব আল মাসুদ বলছিলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ঘনিয়ে আসলেও বলার মতো অগ্রগতি নেই। হত্যাকাণ্ডের ১৯দিন পর কুষ্টিয়া থেকে শরিফুল ইসলাম শিহাব নামে একজনকে ডিবি গ্রেপ্তার করে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শরিফুল পাঁচ/সাতটি সাংগঠনিক নাম জানায়। অগ্রগতি বলতে এটুকুই।
“দেখুন, আমাদের কাছে এখনো পর্যন্ত যে পাঁচ-সাতজন সন্দেহভাজনের নাম রয়েছে, তাদের বেশির ভাগের সত্যিকারের নাম অজানা। এমনকি আমাদের হাতে গ্রেপ্তার থাকা শরিফুলসহ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কোনো সদস্যই সন্দেহভাজনদের নাম-ঠিকানা বলতে পারেনি। আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি,” বেনারকে বলেন রাজীব আল মাসুদ।
বিজ্ঞান মনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় ও তাঁর প্রকাশক জাগৃতির ফয়সাল আরেফীন দীপনের সম্ভাব্য হত্যাকারীদের ছবি প্রকাশ করেছিল ডিবি। তবে জুলহাজ ও তনয়ের হত্যাকারীদের কারও ছবি এখনো ডিবির হাতে নেই। ফলে সহসা ছবি প্রকাশ করে তথ্য আহ্বান করার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন ওই কর্মকর্তা।
আশা দেখছে না পরিবার
জুলহাস মান্নানের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান। তিনি বলছিলেন, ভাইয়ের খুনিদের বিচার হবে সে আশা তিনি করেন না। তিনি তাঁর বৃদ্ধা মা–কে সামাল দেওয়া নিয়ে চিন্তিত। জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় যখন খুন হন, সে সময় বাসায় উপস্থিত ছিলেন জুলহাজের সত্তোরোর্ধ মা।
“মা–কে সামাল দেওয়াই মুশকিল। বয়স হয়েছে, অনেক কথা তিনি ভুলে যান। তবু মাঝে মাঝে ছোট ভাইটার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। আমরা এটা-ওটা বলে বুঝ দিই,” মিনহাজ মান্নান বেনারকে বলেন।
আত্মেগাপনে থাকা সমকামী অধিকার আন্দোলনের একজন কর্মী জানান, বাংলাদেশের পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারায় সমকামীতাকে দণ্ডণীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। সমাজও সমকামিতাকে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় এখনো। এর মধ্যেই জুলহাজ ও মাহবুব রূপবান পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন।
২০১৪-১৫ সালে সমকামী অধিকার প্রতিষ্ঠায় পয়লা বৈশাখে তাঁরা রংধনু র্যালিও করেন। পরের বছর আর অনুমতি পাননি। সামাজিকভাবে ইস্যুটি নিয়ে এখনো তেমন আলোচনা নেই, সে কারণে পরিবারগুলোও বিচারের দাবিতে খুব সোচ্চার নন। তাঁরা কাউকে পাশে পাবেন এমনটাও আশা করেন না। সংবাদমাধ্যমগুলোও অনেকটা চুপ।
সমকামীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন হোঁচট খেল
সমকামী তরুণদের সংগঠন বয়েজ অব বাংলাদেশ এর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে প্রথম রেঙ্গু নামের এক আদিবাসী বাংলাদেশে সমকামীদের প্রথম সংগঠন ‘গে বাংলাদেশ’ এর সূচনা করেন। তিনি একাই ওই সংগঠনটি চালাতেন। সদস্য সংখ্যা ছিল হাজার খানেক। ২০০৪ সালে রেঙ্গুর মৃত্যুর পর সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
২০০২ সালে টিন গে বাংলাদেশ ও পরের বছর বাংলাদেশ গে বয়েজ এবং বয়েজ অব বাংলাদেশ (বব) নামে দুটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে শুধু বয়েজ অব বাংলাদেশ।
২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে অধিকার রক্ষার আন্দোলনে বয়েজ অব বাংলাদেশকে দেখা গেছে। তাঁরা দেশে বিদেশে কর্মশালা করেছেন, অনলাইন যোগাযোগের পাশাপাশি নিয়মিত গেট টুগেদার করেছেন, রূপবানে লিখেছেন।
জুলহাজ মান্নান ও তনয়ের মৃত্যুর পর বয়েজ অব বাংলাদেশ আড়ালে চলে যায়। রূপবানের প্রকাশনাও এখন বন্ধ। বয়েজ অব বাংলাদেশের প্রধান তানভীর আলিমের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটে দেওয়া ঠিকানায় ই-মেইল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংগঠনের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁদের কারও জীবনের নিরাপত্তা নেই।
“আমরা নিহত দুই বন্ধুকে স্মরণ করি। তাঁদের শুভ কামনায় আমরা কাল প্রার্থনাসভায় মিলিত হচ্ছি। কিন্তু আমরা কোনো প্রচার এই মুহূর্তে চাই না,” ওই সূত্রটি বেনারকে বলেন।
তাঁর মতে, জুলহাজ-মাহবুবের শুভাকাঙ্ক্ষীরা যেমন শুভকামনা জানাচ্ছেন, খোঁজখবর করছেন; প্রতিক্রিয়াশীল অংশটি তেমনি জুলহাজ-মাহবুবের শুভাকাঙ্ক্ষীদের চিহ্নিত করে চাপাতিতে শান দিচ্ছে।