ভারতে প্রাকৃতিক কারণে প্রতি চারজনের একজন মারা যান বজ্রপাতে
2017.05.25
কলকাতা

ভারতে প্রাকৃতিক কারণে প্রতি চারটি মৃত্যুর একটি বজ্রপাতে হলেও বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্বীকৃতি না দেওয়ায় নিহত ও আহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
“বাজে সাধারণত গরিব মানুষ, বিশেষত কৃষকদের মৃত্যু হয়। তাদের মাঠে-ঘাটে কাজ করতে হয়,” বেনারকে বলেন কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বাম নেতা রবি বর্মণ।
বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঠেকানোর ক্ষেত্রে ভারত সরকারের মনোভাব মোটেই সন্তোষজনক নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “বজ্রপাতের বিষয়টিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো সত্ত্বেও তা ভারত সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করছে না।”
“এর ফলে বজ্রপাতে নিহত ও আহতদের পরিবার পর্যাপ্ত সরকারি ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে,” বলেন রবি বর্মণ।
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে মোট ১০,৫০০ টি মৃত্যুর মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৪১, বা প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যুর ২৫.১ শতাংশ। যা আগের বছরের তুলনায় ২.৩ শতাংশ বেশি।
২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৮২ জন।
২০১৬ সালের পরিসংখ্যান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত না হলেও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমসস্ফিয়ার বিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবাশীষ লোহার বলেন, “বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা যাচ্ছে, আবহাওয়ার উষ্ণায়নের ফলে বজ্রপাতের ঘটনা আরও বাড়বে। বাজে মৃত্যুর ঘটনা মোকাবিলায় মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি।”
আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড, আসাম ও ওড়িশার মতো রাজ্যে বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি।
পশ্চিমবঙ্গের দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তর জানায়, এ বছরের মে মাসেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বাজের আঘাতে।
২০১৫ সালে বাজ পড়ে পশ্চিমবঙ্গে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৯১ জন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তর সূত্রমতে, বহু ক্ষেত্রেই বাজে মৃত্যুর ঘটনা প্রশাসনকে জানানো হয় না। এ জন্য সব তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণের সুযোগ কম।
“বন্যা বা ভূমিকম্পের মতো বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রচার হয় না। বর্ষা মৌসুমে এটা নিয়মিত ঘটে,” বেনারকে বলেন অধ্যাপক লোহার।
প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী বাংলাদেশে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আওতায় আনা হয়েছে। এর আওতায় হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয় স্থানীয় জেলা প্রশাসন।
বাজ নিয়ে সতর্কতা জারির সুযোগ নেই
অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারির ব্যবস্থা থাকলেও বাজের পূর্বাভাষ দেওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক লোহার। তিনি বলেন, “বাজ মুহূর্তের মধ্যে আঘাত হানে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা হলেও কোথায় বাজ আঘাত হানবে তা বলা রীতিমতো দুঃসাধ্য।”
বাজ সম্পর্কে আলাদাভাবে সতর্কতা জারির ব্যবস্থা না থাকলেও “ঝড়ের পূর্বাভাষ দেওয়ার অর্থই হলো বাজ নিয়ে সতর্ক থাকা,” বেনারকে জানান কলকাতার মেটিওরোলোজিকাল সেন্টারের বিজ্ঞানী হাবিবুর রহমান বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “বাজ বা লাইটনিং ডিটেকশন করার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। তা এখনো সর্বত্র বসানো হয়নি।”
তবে আবহাওয়া দপ্তর সূত্র জানায়, ভারতের একমাত্র বাজ বা লাইটনিং লোকেশন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা মহারাষ্ট্রের পুনেতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিওরোলোজিতে গড়ে তোলা হয়েছে।
এই ব্যবস্থা সারা ভারতে বিস্তার করা হবে বলেও জানায় আবহাওয়া দপ্তর।
জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার দাবি
বাজকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা কমিটিতে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা এখনো কার্যকর করা হয়নি বলে বেনারকে জানান বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সম্পাদক কিরীটী রায়।
তিনি বলেন, “ফলে বাজে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বা তার পরিবার বন্যা বা ভূমিকম্পের মতো নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ ও ত্রাণ পান না। তবে বিভিন্ন রাজ্য সরকার তাদের মতো করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে।”
“এটা মনে রাখা জরুরি যে বন্যা ও ভূমিকম্প নিয়মিত ঘটে না। কিন্তু বাজ পড়ার ঘটনা মে থেকে অক্টোবরের মধ্যে নিয়মিত ঘটে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষই এর শিকার হন,” বলেন কিরীটী রায়।
এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের আধিকারিক বিদেশ সরকার বেনারকে জানান, “পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বর্ষার মৌসুমে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে নিয়মিত প্রচার করা হয়। বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার হলে কী কী করণীয় তাও জানানো হয়।”
“তবে গ্রামের গরিব খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে তা সব সময় মেনে চলা সম্ভব হয় না,” বলেন বিদেশ সরকার।
তিনি জানান, ভারত সরকারের তরফ থেকে বজ্রপাতকে এখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা না হলেও পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যুতে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
“কেন্দ্রীয় সরকার যদি এটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তবে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে,” বলেন বিদেশ সরকার।