ভুয়া সংবাদ ঠেকাতে তৎপর ‘বিডি ফ্যাক্ট চেক’

শরীফ খিয়াম
2018.04.06
ঢাকা
বিডি ফ্যাক্ট চেক-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বাংলা ইনসাইডারে প্রচারিত একটি ভুয়া সংবাদের তথ্য যাচাই প্রতিবেদন দেখছেন একজন পাঠক। বিডি ফ্যাক্ট চেক-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বাংলা ইনসাইডারে প্রচারিত একটি ভুয়া সংবাদের তথ্য যাচাই প্রতিবেদন দেখছেন একজন পাঠক। ৬ এপ্রিল ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

বাংলাদেশের নাগরিকদের গণমাধ্যম জ্ঞান বাড়াতে চায় দেশের প্রথম তথ্য যাচাইকারি সাইট ‘বিডি ফ্যাক্ট চেক’ ডটকম। এরই অংশ হিসেবে গত এক বছরে বাংলা ভাষায় বহুল প্রচারিত ৭০টি ভুয়া সংবাদের সত্যতা উন্মোচন করেছে ওয়েবসাইটটি।

সাইটটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জাহেদ আরমান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “জনসাধারণের মধ্যে ‘মিডিয়া লিটারেসি’ বাড়ানো গেলে তারা সহজেই বুঝতে পারবে কোনটি ভুয়া তথ্য আর কোনটি সঠিক।”

“সঠিক ‘মিডিয়া লিটারেসি’ না থাকায় অনেক বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদেরও ভুয়া সংবাদ শেয়ার করতে দেখা যায়,” যোগ করেন তিনি।

“এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জনসাধারণের মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানো,” এমনটা দাবি করে তিনি আরো বলেন, “বিভিন্ন বিষয়ের ফ্যাক্ট চেক করার পাশাপাশি বিডি ফ্যাক্টচেক-এর একটা অন্যতম প্রধান কাজই হচ্ছে এটা।”

তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজি শুক্রবার বেনারকে বলেন, “মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানোর আগে মিডিয়াকে লিটারেট করতে হবে। দেশের মিডিয়ার ওপরে মানুষের আস্থা নেই বললেই চলে।”

“যাচাই বা একাধিক সূত্রের সমর্থন ছাড়া মিডিয়া কিছু বলার অধিকার রাখে না,” মন্তব্য করে আলী আর রাজি বলেন, “কিন্তু আমাদের মিডিয়া তেমন করে চিন্তাই করে না।”

“এর পেছনে মিডিয়াকর্মীদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা-দীক্ষা এবং গণতন্ত্র নিশ্চিত করার ব্যাপার যেমন আছে, তেমনি আছে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দিকটিও,” যোগ করেন তিনি।

জানতে চাইলে বিডি ফ্যাক্ট চেক বা বিশ্বের কোনো ফ্যাক্ট চেকিং সাইট সম্পর্কে “আমি এ ব্যাপারে ঠিক জানি না,” বলে শুক্রবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

তবে তাঁর মতে, “যেসব মেইনস্ট্রিম মিডিয়া তথ্য ‘ক্রসচেক’ না করেই নিউজ করছে, তাঁরা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ আছে। লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী তথ্য ভেরিফাই করে দেয়াই তাঁদের দায়িত্ব।”

ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বিডি ফ্যাক্ট চেক অলাভজনক, অরাজনৈতিক ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান। পাঠকের ‘ডোনেশন’ থেকেই সংস্থার যাবতীয় ব্যয় বহন করা হয়।

তারা ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক প্রণীত ফ্যাক্ট চেকার্স কোড অব প্রিন্সিপালস্’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেও সাইটে উল্লেখ রয়েছে।

“আমরা সাত জনের একটা টিম কাজ করছি, যারা সবাই কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিকতার সাথে একডেমিক্যালি অথবা প্রফেশনালি জড়িত আছি,” বলেন জাহেদ।

কয়েকটি গুজব ও তাণ্ডব

“গুজব থেকে রেহাই পাচ্ছে না দেশের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমও,” বলে দাবি করা হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক সংবাদে।

গত অক্টোবরের ওই প্রতিবেদনে তৎকালীণ প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে ‘মিথ্যা সংবাদ’ প্রচারের ঘটনা গুরুত্ব পায়। ফটোশপের সাহায্যে দেশের জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতার প্রতিলিপি বানিয়ে ভুল সংবাদসহ সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের ঘটনা ঘটেছিল তখন।

এছাড়া ‘জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়া এবং ফেসবুকে ছড়ানো গুজবের জেরে নাসিরনগরের হিন্দু এলাকায় তাণ্ডব এবং কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনাও উল্লেখ করা হয়।

আলী আর রাজির মতে, “মিথ্যা সংবাদ প্রচার বা তথ্য বিকৃতির ফলে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় তার মুখ্য কারণ প্রচারণা নয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক, গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত স্বার্থ কাজ করে।”

এই বক্তব্যকে সমর্থন করে জাহেদ বলেন, “বাংলাদেশে কখনো সম্মতি উৎপাদনের জন্য ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আবার কখনো স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ভূয়া তথ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। আর তা ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে।”

তাঁর মতে, “সাংবাদিকদের প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে ফ্যাক্ট চেক করে দেখা। কারণ সাধারণ মানুষ মনে করে সংবাদপত্রে যা লেখা হয় তার সবই সঠিক।”

বেশি অভিযোগ বাংলা ইনসাইডার ঘিরে

বিডি ফ্যাক্ট চেক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুয়া সংবাদ প্রচার করেছে বাংলা ইনসাইডার নামের একটি নিউজ পোর্টাল।

তাঁরা ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ নামের একটি অস্তিত্বহীন গবেষণা সংস্থার বরাত দিয়ে গত প্রায় বছর দুয়েক ধরে একের পর এক ভুয়া সংবাদ পরিবেশন করছে বলে জানায় প্রতিবেদনটি।

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন, তিনি পৃথিবীর দ্বিতীয় সৎ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, হার্ভার্ডে তাঁকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে, তিনি বিশ্বে চতুর্থ কর্মঠ সরকার প্রধান, বিশ্ব মানবতার চ্যাম্পিয়ন বা তিনি বিশ্বের সবচেয়ে মিতব্যয়ী রাষ্ট্রপ্রধান।”

‘বাংলা ইনসাইডার’ প্রকাশিত এ জাতীয় সংবাদ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিডি ফ্যাক্ট চেক লিখেছে, “এভাবে ভুয়া তথ্য দিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে সচেতন মানুষের কাছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করা হচ্ছে।”

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলা ইনসাইডারের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ বোরহান কবীর শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বিডি ফ্যাক্ট চেক এর কোনো প্রতিবেদন আমি খেয়াল করিনি। ফ্যাক্ট চেকিং কী? কারা কোথায় কোত্থেকে পয়দা হয়েছে তা আমি জানি না।”

“তারা কী বলছে না বলছে সেটাও আমি দেখিনি, জানি না তাদের অভিযোগ কী। আর না জেনে এ ব্যাপারে আমি তাৎক্ষণিক বক্তব্য রাখতে পারব না,” যোগ করেন এই সিনিয়র সাংবাদিক।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বাংলা ইনসাইডারের কথা আমি শুনেছি। তারা কী সব জানি করছে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও অনেক সময় তাঁদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং অনেকেই আইনের আওতায় আসার ঝুঁকিতে পড়ছেন।”

তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের জন্য দুই ধরনের বাধ্যবাধকতা আছে। একটি দেশের আইন। অন্যটি বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতার যে স্বতঃসিদ্ধ নৈতিকতা, যা আইনেরও উর্দ্ধে।”

“কোনো প্রতিষ্ঠান যখন এটা ভুলে যায়, তখন সে নিজেই শুধু নয়, পুরো মেইনস্ট্রিম মিডিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়,” যোগ করেন এই সাংবাদিক নেতা।

এক বছরে ৭০টি ফ্যাক্ট চেক

২০১৬ সালে পেনসিলভানিয়া এডিনবারো ইউনিভার্সিটিতে আর্টস ইন কমিউনিকেসন স্টাডিজ অধ্যায়নকালে প্রফেসর ড. সুসান জেড সোয়ানের সুবাদে ‘ফেইক নিউজ’ নিয়ে আমেরিকান ফ্যাক্টচেক সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন জাহেদ।

জাহেদ বলেন, “তখন লক্ষ করলাম বাংলাদেশেও সামাজিক মাধ্যমে অনেক বেশি ফেইক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে। এরপরই মাথায় আসে বাংলাদেশ কেন্দ্রীক এ রকম একটা সংস্থা করা গেলে তা দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো হবে।”

“সবার একান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল থেকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাক্ট চেক যাত্রা শুরু করি,” বলেন জাহেদ।

তিনি বলেন, “প্রথম বছরে আমরা প্রায় ৭০টি ইস্যুর ফ্যাক্ট চেক করি। একটা ফ্যাক্টচেক সংস্থা হিসেবে এটা আমাদের সফলতাই বলা যায়।”

কক্সবাজারে জন্ম নেয়া জাহেদ মনে করেন, “এখন অনেকেই ‍বুঝতে পারছে কোনটা ফেইক আর কোনটা সঠিক নিউজ। এটা বিডি ফ্যাক্ট চেক এর অন্যতম সফলতা।”

তবে আলী আর রাজির মতে, “ফ্যাক্ট চেকিংয়ের সাইটগুলো সম্পর্কে সাধারণ ব্যবহারকারীরা জানে কম। সারা বিশ্বেই এই সমস্যা রয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।