বিদেশ সফরকালে সাংবাদিকদের গতিবিধি নজরদারি করবে সরকার

জেসমিন পাপড়ি ও কামরান রেজা চৌধুরী
2017.05.18
ঢাকা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী (মাঝখানে)। মে ১৯, ২০১৭।
স্টার মেইল

বিদেশ সফরে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করবে সরকার। বিদেশে বাংলাদেশের সব দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনে গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এমন আদেশ পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশের আলোকে এই নজরদারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, “জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যারাই বিদেশে যাচ্ছে তাঁদের সবার ওপরে নজর রাখা আমাদের কর্তব্য। সরকারের কর্তব্য। এর মানে এই নয় যে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।”

তাঁর মতে, “বাংলাদেশের মতো স্বাধীন গণমাধ্যম পৃথিবীর কম দেশে আছে। কিন্তু এখানে যা খুশি তাই লেখা হচ্ছে। বিদেশে গেলে কে কী করছে সেটি দেখা উচিত। কেউ যদি স্বার্থবিরোধী কিছু করে তবে সে ক্ষেত্রে নজরদারির ব্যাপারে সবার সমর্থন থাকা উচিত।”

তবে সাংবাদিক নেতা, বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মীরা সরকারের ওই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিষয়টি নিন্দনীয় উল্লেখ করে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

প্রসঙ্গত, বিদেশে বাংলাদেশের সব দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনে পাঠানো বার্তা সাংবাদিকদের মাঝেও বিতরণ করা হয়।

এতে বলা হয়, বিদেশ সফরকালে সাংবাদিকদের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কিছু পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশন থেকে বিষয়টি প্রতিবেদন আকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এর সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বেনারকে বলেন, “এই আদেশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

“আমি বুঝতে পারি না কেন সাংবাদিকদের ওপর নজরদারির এমন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আমরা প্রায়ই বিভিন্ন দেশে যাই এবং আন্তর্জাতিক ফোরামকে বলি যে সাংবাদিকদের হত্যার বিচার হচ্ছে না। এ ধরনের বক্তব্য দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে—এমন ভুল ধারণা হতে পারে।”

সাংবাদিক নেতারা এ বিষয়ে আগামী রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন বলেও জানান মঞ্জুরুল আহসান।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির ১২তম সভায় বিদেশে সফররত বাংলাদেশি সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করার সুপারিশ করা হয়। বিদেশ সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি। এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভুল তথ্য দিয়ে থাকে।

অন্য পেশাজীবীদের বাদ দিয়ে কেবলমাত্র সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি বৈষম্যমূলক কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এ সংক্রান্ত সার্কুলারটি আমি দেখিনি। আমি এটা দেখব।”

নজরদারি সংক্রান্ত এ আদেশ প্রত্যাহার করে মিশনগুলোকে সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে সহযোগিতার নির্দেশ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান সাংবাদিকেরা।

এ সময় মাহমুদ আলী বলেন, “এটাতো নির্দেশ দেওয়ার কিছু নাই। আমরা বিদেশি সাংবাদিকদের দাওয়াত দিচ্ছি। সবাই সব জায়গায় যাচ্ছে। কোনো বিধিনিষেধ আছে বলে আমার জানা নাই। আপনারাও (বাংলাদেশি সাংবাদিক) বিদেশে যাচ্ছেন, কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না। কাউকে বাধা দেওয়া হলে আমাকে জানাবেন।”

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশনের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের কিছু সাংবাদিক দেশটি সফর করেছেন। গত ৩০ মার্চ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১২তম বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সাংবাদিকদের পাকিস্তান সফরের প্রসঙ্গ টেনে বিষয়টির সূত্রপাত করেন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য মাহজাবিন খালেদ।

সাংবাদিকদের বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি করা যায় না বলে মন্তব্য করেন কমিটির সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি।

তবে কোনো সাংবাদিক বিদেশে গিয়ে দেশবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হয় কি না সে বিষয়ে খোঁজখবর রাখা বা নজরদারি করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে কেবল মাত্র পাকিস্তানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে সকল দেশের ক্ষেত্রে এই নজরদারি চালু রাখার বিষয়ে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ডিক্যাবের সাবেক সভাপতি মাসুদ করিম বেনারকে বলেন, “পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন তিনি বিষয়টি দেখবেন। আমরা আশা করি অবিলম্বে এ নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হবে।”

সাংবাদিক সংগঠনগুলোর উদ্বেগ

বিদেশ ভ্রমণকালে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখার নির্দেশনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ। অবিলম্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এই নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান বিএফইউজের একাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ ও মহাসচিব এম আবদুল্লাহ এবং ডিইউজের একাংশের সভাপতি আবদুল হাই শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান।

বিবৃতিতে এই নির্দেশনাকে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে সরকারের নতুন ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়।

সাংবাদিক নেতারা জানান, “এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এই নির্দেশ মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাংবিধানিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। উপরন্তু সাংবাদিক হয়রানির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।