সংবাদমাধ্যমের ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরির অভিযোগে আরও দুজন গ্রেপ্তার
2018.11.29
ঢাকা

বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও অনলাইন নিউজপোর্টালের ওয়েবসাইট নকল করে মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রচারের অভিযোগে আরও দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন—র্যাব।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও গাজীপুরের টঙ্গী থেকে বুধবার রাতে কামাল হোসেন (২৩) ও মো. আল আমিন (৩০) নামের ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানান র্যাব-২–এর পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন ফারুকী।
এই নিয়ে গত এক সপ্তাহে ভুয়া ওয়েবসাইট বানানোর অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলো। র্যাব বলছে, তিনজনই একই চক্রের সদস্য এবং তারা ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী।
গত শনিবার একই অভিযোগে বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকা থেকে এনামুল হক নামে এক পিএইচডি গবেষককে আটক করে র্যাব। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আদলে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। এসব নকল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পাঠকদের বিভ্রান্ত করে ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, বিডি নিউজ, বাংলা ট্রিবিউন, আমার দেশ, নয়াদিগন্তসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূল ওয়েবসাইটের নামের সঙ্গে একটি হরফ যোগ করে দিয়ে একই রকম লোগো ও ইউআরএল ব্যবহার করা হচ্ছে। সেসব ভুয়া খবর ফেইস বুকেও ছড়ানো হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব কাজের উদ্দেশ্য একেবারেই রাজনৈতিক। আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই প্রবণতা আরও বাড়তে পরে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘটনাটি যেহেতু ঘটেছে, সে বিবেচনায় এই কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক। নির্বাচনকালে এসব ভুয়া খবর বাড়তে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সবার সতর্কতা জরুরি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক মনে করেন, “নকল ওয়েবসাইট খুলে রাজনৈতিক সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টি ক্ষমতাসীন এবং যারা ক্ষমতার বাইরে আছে—উভয়পক্ষের জন্যই অন্যতম অস্ত্র হবে। নির্বাচনে ফলাফল প্রভাবিত করার জন্য সবপক্ষ এই চেষ্টা করতে পারে।”
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার দুজনের মধ্যে আল আমিন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে সিএসই পড়েছেন। আর কামাল পড়ছেন কুমিল্লার নওয়াব ফয়েজুন্নেছা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিবিএ (ব্যবস্থাপনা) তৃতীয় বর্ষে।
পড়ালেখার পাশাপাশি তারা অনলাইনে আউট সোর্সিং, ডোমেইন-হোস্টিং বিক্রি, ওয়েব পেইজ ডিজাইন, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে আসছিলেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার দুজন নির্বাচন সামনে রেখে অনলাইনে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেশে-বিদেশে ‘সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার’ চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। তারা গত আগস্টে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় গুজব ছড়িয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতেও ভূমিকা রাখে বলেও জানানো হয়।
‘সরকারবিরোধী প্রচারই উদ্দেশ্য’
মহিউদ্দিন ফারুকী জানান, অনুসন্ধান করে র্যাব জানতে পারে, কিছু কুচক্রী মহল রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে সরকারবিরোধী প্রচার–প্রচারণা করছে। তারা মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণকে বেছে নিয়েছে, যা মূলত সাইবার ক্রাইম।
গ্রেপ্তারকৃতদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, নকল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হলে বিএনপি ও জামায়াত বা সরকারবিরোধীরা বেশি লাইক ও শেয়ার দেবে। তাতে করে ফেসবুক থেকে বেশি টাকা আয় করা সম্ভব। সাধারণত, কোনো পোস্ট এক হাজারের অধিক ভিউ, লাইক বা শেয়ার হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে দেয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই অর্থ ডোমেইনের স্বত্বাধিকারী হিসেবে তাঁরা পেয়ে থাকেন।
র্যাব জানায়, বুধবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের বছিলা থেকে কামালকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল ফোন জব্দ করে বেশ কিছু ভুয়া ওয়েবসাইট পরিচালনার আলামত পাওয়া যায়।
পরে কামালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গাজীপুরের টঙ্গী থেকে আল-আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করা হবে বলে জানানো হয়।
সাম্প্রতিক উদাহরণ
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলো জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের পরিচয় ভুল দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বলে একটি স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়। যেখানে তার স্বামী ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মুহম্মদ এরশাদকে তার বাবা হিসেবে লেখা হয়। এ ধরনের তথ্যগত ভুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
তবে প্রথম আলো সূত্র জানায়, এটি আসলে প্রথম আলোর আদলে তৈরি হওয়া অনেকগুলো ভুয়া ওয়েবসাইটের কোনো একটার নিউজ। প্রথম আলোতে এ ধরনের তথ্য দিয়ে কোনো সংবাদ পরিবেশন হয়নি।
ফেসবুক ব্যবহারকারী শামীম আহমেদ বেনারকে বলেন, এই বিষয়টি দেখার পরে আমিও অনেকের মতো প্রথম আলোর সমালোচনা করে পোস্ট দেই। কিন্তু পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি।”
অধ্যাপক ফাহমিদুল হক মনে করেন, এসব গুজব প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে ভুক্তভোগী পত্রিকাগুলো সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি জারির পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও মিডিয়া লিটারেসি দরকার। যাতে তারা ভুয়া ও আসলের নিউজের পার্থক্য বুঝতে পারে। এর পাশাপাশি অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে।