‘অন্যের জন্য’ কথা বলে মালয়েশিয়ায় বন্দি বাংলাদেশি তরুণ রায়হান কবির
2020.08.07
কুয়ালালামপুর, ঢাকা ও ওয়াশিংটন ডিসি

আপডেট: ৭ আগস্ট ২০২০। ইস্টার্ন সময় রাত ১১.০০
করোনাভাইরাস মহামারিকালে প্রবাসী শ্রমিকদের সাথে মালয়েশিয় সরকারের ‘বৈষম্যমূলক’ আচরণের বিষয়ে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবার দায়ে বাংলাদেশি তরুণ রায়হান কবিরের গ্রেপ্তার ও বহিস্কারাদেশের ঘটনাকে মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেকেরা।
গত ২৪ জুলাই থেকে মালয়েশিয়া আটক রয়েছেন রায়হান কবির (২৫)। তাঁকে মালয়েশিয়ায় আজীবন নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তবে ফেরত পাঠানোর তারিখ এখনো ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন দেশটির অভিবাসন বিভাগের প্রধান।
রায়হানকে কবে বাংলাদেশে পাঠানো হবে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে বৃহস্পতিবার কুয়ালালামপুরে দেশটির অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক খাইরুল জামি দাউদ বলেন, “বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে প্রথম ফ্লাইটটি রয়েছে ৩১ আগস্ট।”
এদিকে রায়হান মালয়েশিয়ায় তাঁর ‘কাজের অনুমতির শর্ত লঙ্ঘন’ করায় সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে জানিয়ে দেশটিতে তিনি ‘অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি’ বলে বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিবাসন বিভাগের এক কর্মকর্তা।
রায়হানকে কেন আটক করা হয়েছে সে বিষয়ে মালয়েশিয়ার এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে চলতি সপ্তার শুরুর দিকে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জইনুদ্দিন জানান, অভিবাসন আইন অনুযায়ী যদি কাউকে দেশটিতে অনাকাঙ্খিত হিসেবে গণ্য করা হয় তবে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার সুযোগ রয়েছে।
“অনাকাঙ্খিত যে কোনো ব্যক্তিকে আমরা তাঁর দেশে ফেরত পাঠাতে পারি। তিনি (রায়হান) অনাকাঙ্খিত,” বলেন হামজা জইনুদ্দিন।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মী শাহ আলমের ছেলে রায়হান ছয় বছর আগে পড়াশোনা করতে মালয়েশিয়া যান। খণ্ডকালীন কাজের পাশাপাশি সেখানে স্নাতক শেষ করে তিনি গত বছর একটি পূর্ণকালীন কাজে যোগ দেন বলে বেনারকে জানান রায়হানের বাবা।
কিন্তু সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক আল জাজিরা টিভির একটি প্রামাণ্য চিত্রে রায়হানের সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর তাঁর জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।
ওই সাক্ষাৎকারে রায়হান জানিয়েছিলেন, মহামারির সময় বৈধ কাগজপত্র না থাকা প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষা ও সহায়তা দেবার নামে গ্রেপ্তার করে আটককেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আল জাজিরার ‘লকড আপ ইন মালয়েশিয়া’স লকডাউন’ তথ্যচিত্রে রায়হান বলেন, “তাঁরা আমাদের জন্য একটি ফাঁদ পেতেছে।”
ওই তথ্যচিত্রে দেখানো হয়, রায়হান একটি আটককেন্দ্রে বন্দি এক বন্ধুর সাথে দেখা করার চেষ্টা করছেন এবং সেই বন্ধুকে সহায়তার জন্য একজন আইনজীবীর সাথে কথা বলছেন।
“কেউ ভাবতেই পারেনি যে তাঁরা লোকজনকে গ্রেপ্তার করবে। এরা কেউ খুনি নয়, অপরাধি নয়। তাঁদের শুধু কাগজপত্র নেই,” বলেন রায়হান।
এদিকে আল জাজিরার ওই তথ্যচিত্রকে ‘ভিত্তিহীন’ ও এর মাধ্যমে দেশের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ণ করার দায়ে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ আল জাজিরার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত চালায়। পাশাপাশি গ্রেপ্তারের জন্য রায়হানকেও খুঁজতে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রায়হানকে প্রচুর হুমকি দেওয়া হয়, দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষ তাঁর ঠিকানা প্রকাশ করে দেয়। এ অবস্থায় ২৪ জুলাই কুয়ালালামপুরে রায়হানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আটককেন্দ্রে রায়হানের সাথে ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে জানিয়ে তাঁর একজন আইনজীবী জানান, রায়হান দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুত।
“যত দ্রুত সম্ভব রায়হানের দেশে ফেরা নিশ্চিত করতে তাঁর পরিবারের পক্ষে আমরা কাজ করছি,” বলেন আইনজীবী সিআর সেলভারাজা।
তিনি বলেন, “রায়হানকে আরো ১৩ দিন অভিবাসন বিভাগে আটক রাখার বিষয়ে আদালতের আদেশ পুনর্বিবেচনা করার জন্য বৃহস্পতিবার আবেদন জানিয়েছি আমরা।”
‘ছোটবেলা থেকেই ঠোঁটকাটা’ রায়হান
রায়হানের বাবা শাহ আলম নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি এলাকায় একটি নিট কারখানায় কাজ করেন, বসবাস করেন বন্দরের গ্রামের বাড়িতে।
তিনি জানান, ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মালয়েশিয়ায় আইন বিষয়ে পড়ার ইচ্ছা জানান রায়হান।
ধার-কর্জ করে ছেলেকে কুয়ালালামপুর পাঠান তিনি।
রায়হান “ছোটবেলা থেকেই ঠোঁটকাটা স্বভাবের। সত্য কথা বলে দেবেই,” বলেন শাহ আলাম।
তিনি বলেন, “আমি অনেকবার তাকে বলেছি, বাবা এত সত্য কথা বলতে হয় না। তখন সে বলত ‘তুমি যদি অন্যের জন্য ভালো কিছু করতে চাও তাহলে তোমাকে সত্য কথা বলতে হবে, অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে।”
“আমার ছেলেকে নিয়ে শঙ্কিত, তবে আমি গর্বিত। আমার ছেলে অন্যের জন্য কথা বলেছে, নিজের স্বার্থের জন্য বলেনি,” বলেন শাহ আলম।
রায়হান মালয়েশিয়াতে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করে পরিবারেও কিছু টাকা পাঠাতেন বলে জানান তাঁর বাবা। তবে আইন পড়ার জন্য সে দেশে গেলেও তিনি বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশোনা করে ২০১৯ সালে স্নাতক করেন।
শাহ আলম জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে কুয়ালালামপুরে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে পূর্ণকালীন চাকুরি পান রায়হান।
এদিকে কুয়ালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে রায়হানকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
“বিশ্বের যে কোনো স্থানে কোনো বাংলাদেশি আটক হলে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কনসুলার অ্যাকসেস নিশ্চিত করে নিজ খরচে তাঁর জন্য আইনজীবী নিয়োগ করি,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “মালয়েশিয় সরকার আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কনসুলার সুবিধা দিয়েছে। আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা রায়হান কবিরের সাথে কথা বলেছেন।”
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় আটক বাংলাদেশিদের মধ্যে রায়হান কবির ‘আলাদা’ বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান।
তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আটক বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করেছি। রায়হান কবির অন্যান্যদের চাইতে আলাদা। তিনি কোনো অপরাধ করে আটক হননি। বরং তিনি অভিবাসন কর্মীদের প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে কথা বলেছেন।”
“তিনি নিজের জন্য নয়, অন্যান্যদের পক্ষে কথা বলেছেন। এটি সাধারণত দেখা যায় না,” বলেন শরিফুল হাসান।
শরিফুল হাসান বলেন, “আমরা আশা করি মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ তাঁকে মুক্তি দিয়ে সম্মানের সাথে বাংলাদেশে আসতে সহয়তা করবে। তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসলে আমরা তাঁকে কীভাবে পুনর্বাসন করা যায় সেব্যাপারে সহযোগিতা করব।”
এদিকে রায়হানের মুক্তি ও তাঁর কাজের অনুমতি ফিরিয়ে দেবার জন্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা মালয়েশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
রায়হানের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের আচরণ সকল অভিবাসীর কাছে ‘অধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মুখ খুললে গ্রেপ্তার, বহিস্কার এবং কালোতালিকাভুক্তি’র বার্তা দিচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন।
তিনি বলেন, একটি তথ্যচিত্রে কথা বলার জন্য গ্রেপ্তারের ঘটনা বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক আঘাতের শামিল।
প্রতিবেদন তৈরিতে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে সহায়তা করেছেন নানি ইউসুফ ও আশীফ এন্তাজ রবি।
সংশোধনী: প্রথম প্রকাশনায় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জইনুদ্দিনের পরিচয় ভুল লেখা হয়েছিল।