গবেষণা প্রতিবেদন: ভালো সুযোগ পেলে দেশেই থাকতেন ৯৯ ভাগ সম্ভাব্য অভিবাসী

জেসমিন পাপড়ি
2020.08.19
ঢাকা
200819_IOM_Report_1000.JPG লেবাননের দোরা শহরে একটি শপিং সেন্টারের সিঁড়িতে বসে আছেন দুইজন অভিবাসী বাংলাদেশি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে জীবিকার ভালো সুযোগ পেলে বেশিরভাগ সম্ভাব্য অভিবাসী দেশেই থাকতেন। ১৯ মে ২০২০।
[রয়টার্স]

বাংলাদেশে জীবিকা নির্বাহের ভালো সুযোগ পেলে ৯৯ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী দেশেই থাকতেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ সরকারের সাথে সমন্বয়ে “বাংলাদেশ: সার্ভে ওন ড্রাইভারস্ অফ মাইগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেন্টস্ প্রোফাইল’ নামের প্রতিবেদনটি বুধবার এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা।

এতে বলা হয়, পাঁচটি প্রধান কারণে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে অভিবাসন করেন। তা হলো, জীবিকার অভাব (বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে), অপর্যাপ্ত উপার্জন, অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক সেবার অভাব এবং সীমিত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও আয়ের তারতম্যের জন্য অনেকে বিদেশে যেতে চাইবেন। তাছাড়া বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগটা বাংলাদেশের নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “দেশে আমরা যদি আরো শোভন কাজের সৃষ্টি করতে পারি, শিল্পায়ন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারি; যাতে করে ভালো আয়ের সুযোগ বাড়ে।”

তবে এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, “বৈশ্বিক শ্রম বাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগটা আমাদের নিতে হবে।”

“কারণ, তুলনামূলকভাবে প্রবাসীরা বিদেশে বেশি আয়ও করতে পারবেন আবার স্থানীয় শ্রম বাজারের উপরে চাপও কমবে। আর সেটারও ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে আছে,” ড. মোস্তাফিজ বলেন।

“তাছাড়া প্রবাসীরা যে বিদেশি মুদ্রা পাঠান সেটারও বড় অবদান আমাদের অর্থনতিতে আছে,” বলেন তিনি।

আইওএম জানায়, ২০১৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সর্বমোট ১১ হাজার ৪১৫ জন সম্ভাব্য অভিবাসীর সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা চলতি বছরের জুনের মধ্যে বিদেশ যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

এই গবেষণার অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী পুরুষ (৮৯%) এবং তাঁদের গড় বয়স ২৭।

আইওএম বলছে, এই প্রথম বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ওপর এ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী চিত্র তুলে ধরলেও এটি মহামারিকালীন অভিবাসন চিত্রকে বুঝতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

“শ্রম অভিবাসন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” মন্তব্য করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, “এই খাতকে আরো ভালোমতো বুঝতে, কাজের সন্ধানে বিদেশ গমনকারীদের ডাটাবেজ তৈরি প্রয়োজন।”

বিদেশগামীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বিস্তারিত তথ্যসহ এই ডাটাবেজ “ভবিষ্যতে উন্নত তথ্যনির্ভর অভিবাসন নিশ্চিতেও কাজ করবে,” বলে জানান মুনিরুছ সালেহীন।

তিনি বলেন, “এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের কারণগুলোর বিস্তারিত তুলে এনেছে। উন্নত নীতিমালা ও অনুশীলন তৈরিতে প্রতিবেদনটি আমাদের সহায়তা করবে।”

বছরে শ্রম বাজারে আসেন ২২ লাখ তরুণ

আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৬ষ্ঠ বৃহত্তম উৎস দেশ। আইওএম জানায়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭৮ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে অবস্থান করছেন। প্রতি বছর এদেশে ২২ লাখেরও বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তিতে যুক্ত হন।

কিন্তু স্থানীয় শ্রমবাজার এই সকল কর্মসংস্থান প্রার্থীদের জায়গা দিতে সক্ষম নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার। যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ।

জনপ্রিয় গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য

জরিপে সম্ভাব্য অভিবাসীদের জিজ্ঞেস করা হয় কী কী পরিবর্তন করা হলে তাঁরা দেশে থাকবেন। প্রায় সবাই (৯৯% শতাংশ) উত্তর দেন, উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে তাঁরা বাংলাদেশেই থাকবেন।

উত্তরদাতাদের মধ্যে একজন বলেন, “দেশে আমি যা উপার্জন করি তা দিয়ে ভালোমত জীবন চালাতে পারি না। বিদেশে গিয়ে অনেকেই ভালো করছে, তাই আমিও বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

প্রতিবেদনের উপাত্ত বলছে, অধিকাংশ উত্তরদাতাই মধ্যপ্রাচ্যে গমনে ইচ্ছুক। গন্তব্য দেশ হিসেবে সৌদি আরব সবচেয়ে জনপ্রিয়। মাত্র ১.৪ শতাংশ ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

আইনশৃ্ঙ্খলা পরিস্থিতিও কারণ

আইওএম জানায়, গবেষণায় অংশ নেয়া উত্তরদাতাদের ৩৮ শতাংশ উল্লেখ করেন দেশে আইনের উন্নতি হলে তাঁরা দেশে থাকবেন। ৩৬ শতাংশ উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ২৯ শতাংশ আরো সুলভ স্বাস্থ্যসেবার কথা উল্লেখ করেছেন দেশে থাকার জন্য।

প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী জানান, তাঁরা দেশে থাকবেন যদি তাঁদের আরো অধিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে সহায়তা করা হয়।

সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজ বলছিলেন, “আইনশৃ্ঙ্খলা পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা কিংবা সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসন প্রত্যাশীরা বিদেশে যান বা না যান, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য এসব নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ যিনি বিদেশে যাচ্ছেন তাঁর পরিবার কিন্তু এদেশেই অবস্থান করছেন।”

“তবে মনে রাখতে হবে এসব নিশ্চিত করলেও শুধু বেশি আয়ের জন্যও যে কেউ বিদেশে যেতে পারেন,” বলেন এই অর্থনতিবিদ।

এই প্রতিবেদনের বিষয়ে আইওএম বাংলাদেশ-এর মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, “এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের আর্থ-সামাজিক চালিকা শক্তিগুলো নিয়ে কাজ করতে সহযোগিতা করবে।”

“পাশাপাশি শিক্ষা ও দক্ষতায় বিনিয়োগের গুরুত্ব সম্পর্কে উচ্চস্তরের আলোচনা ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে প্রতিবেদনটি। আমরা যখন অভিবাসী কর্মীদের উপর বিনিয়োগ করি তখন তা তাঁদের জনগোষ্ঠীর উপরও বিনিয়োগ হয়,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।