মালয়েশিয়ায় অনিবন্ধিত বিদেশি কর্মীদের বৈধকরণ প্রক্রিয়া শুরু

হাদি আজমি ও নিশা ডেভিড
2020.11.16
কুয়ালালামপুর
201116-MY-PlanImmigration620.jpg মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় অভিবাসন বিভাগের সদরদপ্তরে দেশটির সাধারণ ক্ষমা কর্মসূচিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদনপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছেন অবৈধ অভিবাসীরা। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯।
[এস মাহফুজ/বেনারনিউজ]

অবৈধ বিদেশি কর্মীদের বৈধকরণের প্রক্রিয়া সোমবার থেকে শুরু করেছে মালয়েশিয়া। এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে। নিবন্ধিত হলে তাঁরা দেশটিতে বৈধভাবে কাজ করতে পারবেন।

তবে মালয়েশিয়ার একটি শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন অভিবাসী শ্রমিকদের তাড়াহুড়া করে বৈধকরণ কর্মসূচিতে যুক্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। নিবন্ধনের জন্য কাউকে টাকা না দেবার জন্য সতর্ক করেছে সংগঠনটি।

“এই নতুন বৈধকরণ কর্মসূচির বিষয়ে আমরা এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাইনি। শুধু ই–মেইলের মাধ্যমে আবেদন প্রক্রিয়া চালু ছাড়া সরকার এখনো এই পরিকল্পনার বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করেনি,” শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় অভিবাসীদের আহ্বান জানিয়ে বলে ‘টেনাগানিটা’ নামের ওই সংগঠনটি।

সংগঠনটি বলে, “সুতরাং কাউকে টাকা দিতে ছুটে যাবেন না। অফিশিয়াল এবং যাচাইকৃত তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।”

এই পরিকল্পনাটি দুই ভাগে বিভক্ত বলে শুক্রবার জানান মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজাহ জয়নুদ্দিন।

“এক, অবৈধ শ্রমিকদের নিজেদের দেশে ফিরে যেতে দেওয়া হবে এবং অপরটি হলো সরকারের পূর্বঘোষিত চারটি খাতে নিয়োগের উদ্দেশ্যে বৈধকরণ,” বলেন হামজাহ জয়নুদ্দিন।

অর্থনীতি পূনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় জনবলের শূন্যতা পূরণে সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অভিবাসী শ্রমিকদের বৈধকরণের এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচিটি শুধু চারটি অর্থনৈতিক খাতের জন্য উন্মুক্ত বলে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিবৃতিতে জানায় দেশটির অভিবাসন বিভাগ। তারা জানায়, আগ্রহী ‘অনিবন্ধিত’ কর্মীরা সোমবার থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ই–মেইলের মাধ্যমে নিবন্ধনের আবেদন পাঠাতে পারবেন।

এতে বলা হয়, “নিয়োগকর্তারা তাঁদের আবেদনপত্রের সঙ্গে কোম্পানির বর্ণনা এবং আগ্রহী বিদেশি শ্রমিকদের তথ্য সংযুক্ত করবেন।”

“কেবলমাত্র উৎপাদন, নির্মাণ, কৃষি ও বৃক্ষরোপণ—এই চারটি খাতের নিয়োগকর্তারাই আবেদন করতে পারবেন,” বিবৃতিতে বলেন মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের প্রধান খাইরুল জামি দাউদ।

যেসব নিয়োগকারী ইতিমধ্যে অভিবাসন বিভাগের কালো তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাঁরা আবেদন করতে পারবেন না বলেও জানান তিনি।

তবে দেশটিতে অবৈধ হয়ে যাবার কারণে বর্তমানে যেসব বিদেশি শ্রমিক কারাগারে রয়েছেন তাঁদের জন্যও নিয়োগকর্তারা আবেদন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজাহ জয়নুদ্দিন। এছাড়া আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যাদের জন্য আবেদন করা হয়েছে তাঁরা দেশটিতে থাকতে পারবেন বলেও জানান তিনি।

গত জানুয়ারিতে ৪০০’র বেশি অবৈধ বিদেশি শ্রমিককে আটক করে মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ। এছাড়া করোনাভাইরাসের লকডাউন নিশ্চিত করার অভিযানের সময়ও দেশটিতে আটক হন আরো কয়েকশ’ অনিবন্ধিত বিদেশি শ্রমিক।

অভিবাসন বিভাগের কাছ থেকে যাচাইয়ের পরে আবেদনকারীদের সমন্বিত বিদেশি শ্রমিক পরিচালনা ব্যবস্থার (ইপিপিএক্স) মাধ্যমে আবেদন করতে হবে বলে ওয়েবসাইটে জানায় দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়।

এই পর্বের আবেদনের সাত দিনের মধ্যে আবেদনটি নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানানো হয় ওয়েবসাইটের তথ্যে।

এতে বলা হয়, আবেদনকারীদের উপযুক্ততা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্পের সময়সীমা এবং গুরুত্বসহ বিভিন্ন বিষয় দেখা হবে।

কৃষি এবং বৃক্ষরোপনের ক্ষেত্রে ঋতু, ফসল ও আবাদের ধরন, জমির পরিমাণ, নিয়োগকর্তাদের ইতিমধ্যে নিয়োগকৃত স্থানীয় এবং বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।

স্থানীয় কর্মীদের কর্মসংস্থান রক্ষার জন্য মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অনুপাত অনুসারে অভিবাসীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য এই যাচাই বলে জানান মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ

অনিবন্ধিত বিদেশি শ্রমিকদের বৈধকরণে মালশিয়ার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ।

“কোভিড-১৯ মহামারিকালে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার যে উদ্যোগ মালয়েশিয়া নিয়েছে সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই,” বেনারকে বলেন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীর।

“অনিবন্ধিত বা অবৈধ কর্মীদের অধিকার বলে কিছু থাকে না,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তাঁরা প্রতিনিয়িত শোষিত হয়। টিকে থাকার জন্য কম মজুরিতে বেশি কাজ করতে বাধ্য হয়।”

মালয়েশিয়ায় বর্তমানে ঠিক কত বাংলাদেশি শ্রমিক অবৈধ বা অনিবন্ধিত অবস্থায় আছেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন, এর মধ্যে আনুমানিক তিন লাখই অনিবন্ধিত।

“এই সুযোগে যদি কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মীও বৈধ হওয়ার সুযোগ পান তাহলে তাঁদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখবে,” মালয়েশিয় সরকারের বৈধকরণ কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীর।

‘শুধু মুনাফাই যেন মুখ্য না হয়’

মালয়েশিয়াতে বিভিন্ন দেশের প্রবাসী শ্রমিকরা মূলত সবচেয়ে কঠিন, বিপজ্জনক বা অপরিচ্ছন্ন কাজগুলোতে নিয়োজিত থাকেন।

মালয়েশিয়া পাম অয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রমতে, সরকারের এই পদক্ষেপ ক্ষুদ্র আবাদকারী এবং ক্ষুদ্র শিল্পগুলোতে জনবলের অভাব কমাতে সহায়তা করতে পারে। শ্রমিকের ঘাটতিতে এই খাতগুলো প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা হারাচ্ছিল।

মানবাধিকার সংগঠন টেনাগানিটা’র নির্বাহী পরিচালক গ্লোরিন এ দাস বলেন, শিল্পে শ্রমিকের ঘাটতি মেটানোয় উপকার হলেও কম সুযোগ–সুবিধা দিয়ে শ্রমিক শোষণ এবং ন্যায় বিচার নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

তিনি বলেন, “এ জন্য তৃণমূল পর্যায়ে অভিবাসী শ্রমিক বা স্থানীয় শ্রমিক, কূটনৈতিক মিশন এবং অভিবাসী কর্মীদের সাথে কাজ করা সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।”

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বিদেশি শ্রমিকদের যেন শুধু মুনাফা বাড়ানোর জন্যই ব্যবহার করা না হয়।

মানবাধিকার কর্মী সুরায়া আলি অনিবন্ধিত অভিবাসীদের নিবন্ধনে সরকারি পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেন, “নতুনভাবে নিবন্ধিত এসব শ্রমিক যাতে নিখোঁজ না হন তার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”

“অনিবন্ধিতরা শুধু বৈধকরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়, তারা কাজ এবং মজুরিও চায়। আর স্থানীয়রা অনিবন্ধিতদের ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী, কারণ নথিপত্র থাকা শ্রমিকদের চেয়ে এদের মজুরি সস্তা,” বলেন সুরায়া।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় ১২ থেকে ১৪ লাখ অবৈধ বিদেশি শ্রমিক কাজ করতেন। দেশটির পামওয়েল বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, নিবন্ধিতদের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ আড়াই লাখের বেশি শ্রমিক কৃষি ও বৃক্ষরোপনে কাজ করেন।

ঢাকা থেকে প্রতিবেদনে তথ‍্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।