যাচ্ছিলেন ইউরোপ, ভাসছিলেন সমুদ্রে, ফিরলেন তিউনিসিয়া থেকে
2019.05.21
ঢাকা

সমুদ্রপথে অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাত্রার পর নৌকা বিকল হয়ে পড়ায় ১৫ বাংলাদেশি ভাসছিলেন ভূমধ্যসাগরে। তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড তাঁদেরকে উদ্ধার করার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সহায়তায় মঙ্গলবার সকালে তাঁরা দেশে ফিরেছেন।
তবে এই দলটির সদস্যরা সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া যাত্রী নন, তাঁরা একই দিনে, একই উদ্দেশ্যে অপর একটি নৌকায় ছিলেন।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর এ এস এম আশরাফুল ইসলাম টেলিফোনে বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “গত ১০ মে ডুবে যাওয়া নৌকায় থাকা ১৪ জন জীবিত বাংলাদেশি এখনো তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্টের আশ্রয় শিবিরে আছেন।”
তিনি বলেন, “ট্রলারের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় দেশে ফেরা এই ১৫ জনের নৌকাটি ৯ মে থেকে মাঝ সাগরে ভাসছিল। তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড ১১ মে তাঁদের উদ্ধার করে।”
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র বেনারকে জানায়, ১০ মে’র নৌকাডুবির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েই এই দলটির খোঁজ পায় বাংলাদেশ। ওই দুর্ঘটনা থেকে ১৪ জন বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও এখনো ৩৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
আশরাফুল জানান, উদ্ধারের সময় ফিরে আসা দলটির সবাই সুস্থ ছিলেন। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে তাঁদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
মঙ্গলবার ভোর ছয়টায় এই ১৫ জন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন। তবে দেশে ফেরার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দীর্ঘ জেরার মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা।
"পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও র্যাবের দীর্ঘ জেরায় মানবপাচারকারী চক্রের ব্যাপারে অনেক তথ্য দিচ্ছেন ওই ১৫ জন," দুপুরে বেনারকে বলেন বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ফিল্ড অফিসার ও প্রশিক্ষক মাহবুবুল হক।
পরবর্তীতে ইমিগ্রেশন পুলিশও তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। সোসাইটির পারিবারিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন বিভাগের ফিল্ড অফিসার শাকিলা আক্তার জানান, “জিজ্ঞাসাবাদ এখনো বাকি আছে।”
“তবে সবার পরিবারের সাথে আমরা যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। পরিবারের সদস্যরা এসেই তাদের নিয়ে যাবে,” বলেন তিনি।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-আমিন নয়ন বেনারকে বলেন, “আগতরা যে তথ্য দিয়েছেন তা যাচাই করে দেখছে তাঁদের স্ব স্ব থানার পুলিশ।”
তাঁদের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইওএম কর্মকর্তাদেরও কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক এনায়েতুল্লাহ একরাম পলাশ বেনারকে বলেন, “অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীরা দেশে ফিরে জেরার সম্মুখীন হলেও তা এতটা দীর্ঘ হয় না সাধারণত।”
আগত ১৫ জনকে খাবার ও পানি সরবরাহ করেছে রেডক্রিসেন্ট। তারা ভালো আছেন উল্লেখ করলেও তাঁদের নাম-পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে সোসাইটির ওই কর্মকর্তা জানান, “এটা সরকার জানাবে।”
এক সোহেল রানার গল্প
ফিরে আসা ১৫ জনের একজন হবিগঞ্জ জেলার বাসিন্দা সোহেল রানা। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক কর্মকর্তার ফোনের মাধ্যমে বেনার প্রতিবেদকের কথা হয় তাঁর সাথে।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের আশরাফুল ইসলাম বেনারকে জানিয়েছিলেন, ট্রলারের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় নৌকাটি সাগরে ভাসছিল, পরে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড দলটিকে উদ্ধার করে। তবে সোহেল ঘটনাটিকে বেনারের কাছে বর্ণনা করেন ভিন্নভাবে।
সোহেল জানান, লিবিয়া থেকে ৯ মে ইফতারের পর তাঁদের ৫৭ জনকে ইতালিগামী একটি নৌকায় তোলা হয়। নৌকাটিতে আটজন নারী ও তিনটি শিশুও ছিল। পরদিন শুক্রবার সারা দিন সাগরে ভাসার পর নৌকায় পানি উঠতে শুরু করে।
নারী ও শিশুদের বাঁচাতে পুরুষেরা নৌকা থেকে নেমে যান। ভাসতে ভাসতে তিউনিসিয়া উপকূলে এলে স্থানীয় জেলেরা এসে তাঁদের উদ্ধার করে।
এর আগে গত ২৮ জানুয়ারি সোহেল স্থানীয় এক দালাল বুলবুলের সহায়তায় লিবিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর তাঁর পরিবার বুলবুলকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দেয়।
পরে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য আরেক দালালকে ব্যাংকের মাধ্যমে আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা পাঠাতে হয়।
“চুক্তি ছিল লিবিয়া থেকে জাহাজে করে ইতালি নেবে। চাকরিরও ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সেসব তো করেইনি। বরং লিবিয়ায় একটি ক্যাম্পে অনেক লোককে তিন মাস আটকে রাখা হয়,” বলেন সোহেল।
তিনি বলেন, সেখানে অন্ধকার আর নোংরা ঘরে থাকতে হতো। দিনে খাবার দিতো একবেলা। তাও নামেমাত্র। ওই ক্যাম্পে সোমালিয়া, মরক্কোসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মানুষও ছিলেন। তারাও ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় ছিলেন।
বিমানবন্দরে স্বজনের খোঁজ
তিউনিসিয়া থেকে ১৫ বাংলাদেশি আসার খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকালে শরীয়তপুরের নড়িয়ার মোল্লাকাঠি থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে ছুটে আসেন দেলোয়ার হোসেন। ছবি হাতে নিয়ে নিখোঁজ সহোদর জহিরুল ইসলামের সন্ধান করছিলেন তিনি।
“কেউ একজন নাকি রেডক্রিসেন্ট কর্মকর্তাদের বলেছেন যে ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে সে (জহির) ছিল না। কিন্তু আমরা তাঁর কোনো সন্ধান পাচ্ছি না।” কৃষক পিতার ২৩-২৪ বছরের সন্তান জহির পেশায় স্যানিটারি মিস্ত্রি ছিলেন বলেও তিনি জানান।
এ ছাড়া গণমাধ্যমে এই ১৫ জনের আসার খবর পেয়ে একইভাবে ফুপাতো ভাই মঞ্জুর আলম হিমেলের সন্ধানে এসেছেন মাহাদি হাসান ফাহি।
“সর্বশেষ টেলিভিশনের সংবাদেই আমরা তাঁকে তিউনিসিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দেখেছিলাম,” বেনারকে বলেন তিনি।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি সূত্র বেনারকে জানায়, নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া ১৪ জনের মধ্যে বুধবার তিনজনকে আইওএমের মাধ্যমে দেশে পাঠানো হবে। বাকিরা এখনো দেশে ফিরতে রাজি না হওয়ায় তাঁদের পাঠানো হচ্ছে না। তাঁদের মধ্যে চারজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।