পাচারকারীদের সামনেই নৌকা ডুবেছে, কিন্তু তারা উদ্ধার করেনি
2019.05.24
ঢাকা

“তারা দেখছিল আমাদের নৌকা ডুবে যাচ্ছে, আমরা সাহায্য চেয়ে চিৎকার করেছি। কিন্তু তারা আমাদের উদ্ধার করেনি।”
এভাবেই বেনারের কাছে নিজেদের পাঁচ মাসের ইউরোপযাত্রার চেষ্টার শেষ পর্বের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় জীবিত ফিরে আসা বেলাল।
তিউনিসিয়া উপকূল থেকে গত ১০ মে উদ্ধার হওয়া ১৪ বাংলাদেশির একজন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের এই বেলাল আহমেদ (৩১)। ওই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ৩৯ বাংলাদেশির মধ্যে বেলালের দুই ভাতিজা এবং এক ভাগ্নেও রয়েছেন।
চোখের সামনে দুই ভাতিজা আবদুল আজিজ ও আহমেদ লিটন এবং ভাগ্নে আহমেদ হোসেনকে পানিতে ডুবে মরতে দেখেছেন বেলাল। তাঁর মতে, পাচারকারীরা চাইলেই সবাইকে বাঁচাতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে পালিয়ে যায়।
“তারা যখন আমাদের ওভাবে ফেলে মাছ ধরার জাহাজ নিয়ে দ্রুত পালাচ্ছে, তখন একের পর এক আমাদের সাথের মানুষগুলো ডুবে যাচ্ছিল,” বলেন বেলাল।
নৌকাডুবিতে বেঁচে যাওয়া ১৪ বাংলাদেশির মধ্যে বেলালসহ তিনজন শুক্রবার সকালে দেশে ফিরেছেন। ফিরে আসা অন্যরা হলেন সিলেটের মাহফুজ আহমেদ (৩০) ও কিশোরগঞ্জের বাহাদুর (২৫)।
পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় সারাদিন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে রাত সাড়ে আটটার দিকে ছাড়েন। রাত নয়টার দিকে বেলাল ও মাহফুজের সঙ্গে বেনার প্রতিনিধির দেখা হয়।
এরপর ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় জীবিত এই দুজন বেনারকে ডিসেম্বর থেকে মে—প্রায় পাঁচ মাসের ইতালি যাত্রার সেই রোমহর্ষক বর্ণনা দেন।
যাত্রা শুরু: দেশ থেকে দেশে
কথা ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে সরাসরি বিমানযোগে ইতালি নেওয়া হবে। এই শর্তে টাকা দেওয়া হয়েছিল মানবপাচারকারীদের, আর স্বপ্নের সেই ইউরোপ যাত্রা শুরু হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে।
“গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে রওনা হওয়ার আগে ইয়াহিয়া ওভারসিজের মালিক এনাম আহমদ চৌধুরী আমাদের বলেছিলেন ভারত থেকে বিমানযোগে সরাসরি ইতালি নেওয়া হবে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে প্রায় পাঁচ মাস পর আমাদের ইতালির কাছাকাছি নেওয়া হয়,” বেনারকে জানান বেলাল ও মাহফুজ।
দেশে ফেরা হতভাগা এই যুবকেরা বলেন, “আমাদের কলকাতা, দিল্লী ও মুম্বাই ঘুরিয়ে প্রথমে শ্রীলঙ্কা নেওয়া হয়। সেখান থেকে কাতার হয়ে তিউনিসিয়া। এরপর লিবিয়ার মিসরাতার একটি ঘরে বন্দী করে মাথাপিছু পাঁচ লাখ টাকা করে আদায় করা হয় স্বজনদের কাছ থেকে। ত্রিপোলিতে নিয়ে আদায় করা হয় মাথাপিছু আরো তিন লাখ টাকা।”
হয়রানি ও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তাঁরা জানান, ত্রিপোলিতে টাকা নেওয়ার পরও প্রায় একমাস বন্দী রাখা হয়েছিল। এরপর তাঁদের জোয়ারা নিয়ে যাওয়া হয়। জোয়ারায় আরও তিন মানবপাচারকারীর আনা লোকজন একত্রিত করা হয়েছিল। এরপর সবাইকে লিবিয়ানদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, ইতালি যাত্রার উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া মানুষদের মধ্যে ৮২ জন বাংলাদেশি, ৫০ জন সৌদি, ১০ জন মিশরীয় এবং দুই জন আফ্রিকা অঞ্চলের মানুষ ছিলেন।
ইউরোপযাত্রা ও নৌকাডুবি
বেলাল বলেন, “৯ মে ভোর রাত তিনটার দিকে লিবিয়ানরা এসে অস্ত্র ও লাঠি দিয়ে আমাদের মারধর শুরু করে। তারপর প্রায় তিন মাইল বন-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমাদের হাঁটতে বাধ্য করা হয়। এরপর নেওয়া হয় সাগরের পাড়ে।”
“সাগরের কাছে নিয়ে আমাদের তিনটা ছোট ছোট নৌকায় তোলা হয়। সেগুলো ঘণ্টাখানেক চালিয়ে মাঝ সাগরে নিয়ে একটি মাছ ধরার বড় জাহাজে তোলা হয়,” যোগ করেন বেলাল।
মাহফুজ বলেন, “আমাদের সাথে যে লিবিয়ানরা ছিল তারা একটা নৌকা নিয়ে চলে যায়, বাকি দুটি নৌকা বড় জাহাজটির সাথে বেঁধে দেওয়া হয়। সেই জাহাজে করে ৯ মে সকাল সাতটার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করি।”
“রাত সাড়ে নয়টায় জানানো হয়, আমরা ইতালির কাছাকাছি চলে এসেছি। এরপর জাহাজের সাথে বেঁধে রাখা নৌকা দুটিতে আবার আমাদের তুলে দেওয়া হয়। প্রথম নৌকায় ৫০-৫৫ জন ওঠে। পরের নৌকায় বাকিদের তুলে দেওয়া হয়, কেউ কেউ রাজি হচ্ছিল না। তাদের তখন মারধর করা হয়,” জানান মাহফুজ।
মাহফুজ বলেন, “৩০-৩৫ জন ধারণক্ষমতার নৌকাটিতে প্রায় দ্বিগুণ লোক ওঠার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেটি উল্টে যায়।”
মাহফুজের দাবি, লিবিয়ান পাচারকারীদের চোখের সামনেই ডুবে গিয়েছিল নৌকাটি। তারা চাইলে সবাইকে উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে নিজেদের জাহাজ নিয়ে পালিয়ে যায়।
বেঁচে ফিরে আসা
“শেষ পর্যন্ত আমরা ১৫ বাংলাদেশি নৌকাটি আঁকড়ে ধরেছিলাম, আর দুই মিশরীয় তেলের ড্রাম ধরে ভেসেছিলেন, জানান মাহফুজ।
তিনি জানান, ১০ মে সকাল সাতটার দিকে তাঁরা দূরে একটি তিউনিসিয়ান মাছের জাহাজ দেখতে পান। চিৎকার করতে থাকেন সবাই মিলে। জাহাজটি এসে তাদের উদ্ধার করার পরপরই এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়।
“তখন আমাদের কারোই কথা বলার মতো শক্তি ছিল না। জাহাজটি আর ১০-১৫ মিনিট পরে আসলে হয়তো আমরা কেউই জীবিত থাকতাম না। পরে মাঝিরা আমাদের তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ডের হাতে তুলে দেন,” বলেন মাহফুজ।
বেলাল জানান, বর্তমানে তিউনিসিয়ায় বাকি যে ১১ জন বাংলাদেশি রয়েছেন, তারাও দেশে ফিরে আসতে চান। কিন্তু তাদের শরীর এখনও দীর্ঘ ভ্রমণের উপযোগী হয়নি বলে মনে করছেন সেখানকার চিকিৎসকেরা।
“আমি চাই ভবিষ্যতে আর যাতে কেউ দালালদের প্রলোভনে এভাবে মৃত্যুর ফাঁদে পা না দেয়,” বলেন বেলাল।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) তত্ত্বাবধানে ও রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতায় দুই দফায় তিউনিসিয়া থেকে ফেরত আসা ১৮ অভিবাসন প্রত্যাশীর মধ্যে সিলেট অঞ্চলেরই ১৩ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলার আটজন, হবিগঞ্জের তিনজন, সুনামগঞ্জের দুইজন। অন্যদের মধ্যে কিশোরগঞ্জের তিনজন ও মাদারীপুরের একজন রয়েছেন।
‘এখনো জিম্মি অনেকে, উদ্ধার করা অসম্ভব’
মাহফুজের মতে, ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশী শতাধিক বাংলাদেশি লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে এখনও জিম্মি আছেন।
“তাদের একইভাবে ইতালি পাঠানোর চেষ্টা করা হতে পারে,” বলেন তিনি।
মাহফুজের শঙ্কার সতত্যা স্বীকার করেছে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস।
সেখানকার শ্রম কাউন্সিলর এ এস এম আশরাফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “যেসব বাংলাদেশি মানবপাচারকারী চক্রের হাতে জিম্মি আছে, আপাতত তাদের উদ্ধার করা অসম্ভব।”
তিনি জানান, গৃহযুদ্ধের কারণে লিবিয়ার এখন যা পরিস্থিতি, তাতে দূতাবাস থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে যেতে পারেন না বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। অন্যদিকে যেসব দুর্গম এলাকায় পাচারকারীদের ঘাঁটি সেগুলো ত্রিপোলী থেকে কমপক্ষে পাঁচশ কিলোমিটার দূরে।
“গৃহযুদ্ধ চলার কারণে দেশটিতে বর্তমানে আইনের শাসন নেই। আমরা নিজেরাই বের হতে পারছি না,” বলেন আশরাফুল।
তাঁর দাবি, যেসব বাংলাদেশি এখানে জিম্মি আছে তারা ইউরোপে গিয়ে সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার লোভে স্বেচ্ছায় মানব পাচারকারীদের হাতে ধরা দিয়েছেন।
২৯০ অভিবাসন প্রত্যাশী উদ্ধার
ভূমধ্যসাগরের উপকূল থেকে আরও ২৯০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছে লিবিয়া কর্তৃপক্ষ। বার্তা সংস্থা এপি জানায়, তিনটি নৌকায় থাকা ওই অভিযাত্রীদের অধিকাংশ আরব ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। তবে এর মধ্যে ১৪ জন বাংলাদেশিও আছেন।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।