লিবিয়া হত্যাকাণ্ড: মানব পাচারকারী চক্রের হোতাসহ গ্রেপ্তার তিন

জেসমিন পাপড়ি
2020.06.01
ঢাকা
200601_Libya_story-1000.jpg লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা হাজী কামালকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর কাছ থেক উদ্ধার করা বিভিন্ন জনের কয়েকটি পাসপোর্ট ও অন্যান্য সামগ্রীর সাথে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে র‍্যাব। ০১ জুন ২০২০।
[বেনারনিউজ]

লিবিয়ায় অপহরণকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশিকে পাচারের সাথে জড়িত সন্দেহে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এদের মধ্যে সোমবার সকালে রাজধানীর গুলশান থানার শাহজাদপুর এলাকা থেকে কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামাল (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন—র‌্যাব।

মানব পাচারের অন্যতম এই হোতা নিহতদের মধ্যে কয়েকজনকে পাচারের সাথে জড়িত বলে র‌্যাবের দাবি।

২৬ বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনায় হতাহতদের স্বজনেরা স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদর ও রাজৈর থানায় তিনটি এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় একটি মামলা করেন।

এ বিষয়ে তদন্ত নেমে গোপন সূত্রে হাজী কামালের সন্ধান পাওয়া যায় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রকিবুল হাসান।

এ ছাড়া মামলার প্রেক্ষিতে এক নারীসহ মাদারীপুরে দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। এরা হলেন; রাজৈর উপজেলার জুলহাস সরদার এবং মাদারীপুর সদর উপজেলার দিনা বেগম।

রা‌জৈর থানার ওসি মো. শওকত জাহান বেনারকে ব‌লেন, “লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে দুইজনের পরিবার দুটি মামলা করেছে। এতে জুলহাস নামে একজনকে আটক দেখানো হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি পুলিশের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।”

এ ছাড়া মাদারীপুর ম‌ডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, লিবিয়ায় নিহত মো. শামিমের বাবা আব্দুল হালিম মিয়ার করা মামলায় রোববার রাতে আসামি নজরুলের স্ত্রী দিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত ২৮ মে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মিজদাহ শহরে বন্দুক হামলায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জন নিহত হন। আহত হন ১১ জন বাংলাদেশি। ওই ঘটনায় চার আফ্রিকান অভিবাসীও নিহত হন।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বেনারকে বলেন, “যারাই মানবপাচারের সাথে জড়িত, তাঁদের খুঁজে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মন্ত্রী বলেন, “লিবিয়া থেকে পাওয়া তথ্য আমরা র‌্যাবকে দিচ্ছি। তার ভিত্তিতে ইতিমধ্যে একজন গডফাদারকে ধরা হয়েছে। র‌্যাব অত্যন্ত ইতিবাচক অ্যাকশন নিচ্ছে। আশা করি বাকিরাও ধরা পড়বে।”

কামাল মানবপাচার সিন্ডিকেটের হোতা

সোমবার সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রকিবুল হাসান জানান, লিবিয়ায় হতাহতদের কয়েকজন হাজী কামালের মাধ্যমে গেছেন। সেখানে তাঁদের নির্যাতন করে দেশে তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা মুক্তিপণের অর্থও টাইলস ব্যবসায়ী কামালের মাধ্যমে গেছে।

র‌্যাব জানায়, টাকার বিনিময়ে ইউরোপে পাঠানোর আশ্বাসে শ্রমিকদের পাচার করতেন কামাল। গত ১০ বছরে অন্তত চারশ বাংলাদেশিকে লিবিয়ায় পাচার করেছেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে হাজী কামাল এসব তথ্য দিয়েছেন বলে জানায় র‌্যাব।

রকিবুল হাসান জানান, লিবিয়ায় হতাহতদের স্বজনদের অভিযোগ অনুযায়ী, তাঁরা হাজী কামালকে মুক্তিপণের টাকা দিয়েও সন্তানদের ফেরত পাননি। এসব টাকার একটি অংশ তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠাতেন।

র‌্যাব জানায়, একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মানব পাচারের এই পুরো প্রক্রিয়া চলে। হাজী কামাল এই সিন্ডিকেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা শুরুতে বিদেশে গমনেচ্ছুদের নির্বাচন করে। তারপর সাত-আট লাখ টাকায় চুক্তি করে। এর মধ্যে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়ায় যাওয়ার আগে এবং বাকি আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লিবিয়ায় যাওয়ার পর তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে নেয়।

চক্রটি শ্রমিকদের কলকাতা হয়ে মুম্বাই, তারপর সেখান থেকে দুবাই ও মিশর হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁদের ইউরোপে পাচারের চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘ এই পথে একেক জায়গার দায়িত্বে পাচারকারীদের কয়েকজন এজেন্ট থাকে।

এই দেশীয় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানায় র‌্যাব।

নিহতদের দাফন সম্পন্ন

লিবিয়ায় নিহত ২৬ জন বাংলাদেশির মরদেহ সেখানেই দাফন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস।

এ ছাড়া ওই ঘটনা থেকে অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে বাঁচা এক বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে। তিনিসহ আহত বাংলাদেশিদের ত্রিপলীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। এদের মধ্যে মো. বাপ্পি নামে একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। বাকিরা বিপদমুক্ত বলে জানান দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের কনসুলার এএসএম আশরাফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করায় লিবিয়ার মিজদাহ শহরে আমরা যেতে পারিনি। মিজদাহ খুবই ছোট ও অনুন্নত শহর হওয়ায় সেখানে লাশগুলো সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল না।”

“ফলে লাশগুলো সেখানে দাফন করা ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সহায়তায় লাশগুলো ওই শহরে দাফন করা হয়েছে,” বলেন তিনি।

লিবিয়ায় বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা ওমর ফারুক বেনারকে বলেন, “আসলে যে হাসপাতালে লাশগুলো ছিল সেখানকার মর্গে জায়গা না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২৬টি লাশ একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখে।”

“কিন্তু পরিস্থিতির কারণে দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে পৌঁছাতে পারেননি। এদিকে লাশেও পচন ধরেছিল। বাধ্য হয়ে দূতাবাসের অনুমতি নিয়ে তারা মিজদাহ শহরের কবরস্থানে লাশগুলোকে শুক্রবারেই দাফন করে,” বলেন তিনি।

আশরাফুল ইসলাম জানান, সেদিনের ঘটনায় পালিয়ে যাওয়া একমাত্র বাংলাদেশিকে শনিবার উদ্ধার করা হয়েছে। গুলি না লাগলেও মানবপাচারকারীদের নির্যাতনের চিহ্ন তাঁর সারা শরীরে। তিনিও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।”

“চিকিৎসাধীন ১২ বাংলাদেশির মধ্যে একজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন, তাঁর মাথায় গুলি লেগেছিল। অস্ত্রপচারের পরে তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। বাকিরা ধীরে ধীরে সুস্থ হবেন আশা করি,” বলেন তিনি।

নিহত বাংলাদেশিদের সংখ্যার বিষয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানান, লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিহত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ২৬ জন বলে জানানো হয়। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিরাও একই তথ্য জানান।

তাঁরা জানান, এসব বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ‘নিহত ২৪ বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি দুজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

আহত বাংলাদেশির বর্ণনা

গুলি থেকে বেঁচে পালাতে সক্ষম হওয়া বাংলাদেশির নাম সায়েদুল ইসলাম। মাদারীপুরের রাজৈরের এই বাসিন্দার সাথে দূতাবাস কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বেনার প্রতিবেদকের কথা হয়।

ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারত, দুবাই ও মিশর হয়ে মাস ছয়েক পুর্বে লিবিয়া পৌঁছান তিনি।

তিনি জানান, ঘটনার ১৫ দিন আগে পাচারকারীরা বেনগাজী থেকে ৩৮ জন বাংলাদেশিসহ কয়েকজন সুদানের নাগরিককে নিয়ে ত্রিপলীর উদ্দেশ্যে রওনা করে। পথে মিজদাহ শহরে অপহরণকারীরা তাঁদের আটক করে প্রত্যেকের কাছে ১০-১২ হাজার ডলার মুক্তিপণ চেয়ে অমানবিক নির্যাতন চালাতে থাকে।

ঘটনার দিন অপহরণকারীরা এলে পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী সুদানের নাগরিকরা তাঁদের ওপর পাল্টা হামলা চালিয়ে অস্ত্র কেড়ে গুলি চালায়। এতে পাচারকারী নেতার মৃত্যু হয়। এসময় তাঁর সহযোগীরা নির্বিচারে গুলি চালায়।

তিনি বলেন, “আমার বন্ধুরা মারা যাচ্ছিল। তাদের লাশের নিচে চাপা পড়েছিলাম আমি। এরপর কারা যেন উদ্ধার করে আমাকে পানি খেতে দেয়।”

“অন্যরা আমাকে হাসপাতালে নিতে চাইলে তাদের বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে আমি পালিয়ে এক লিবিয়ানের কাছে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে বাংলাদিশ কমিউনিটি এবং দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করি,” বলেন তিনি।

সায়েদুল জানান, অন্তত ১০-১৫দিন ধরে অপহরণকারীরা প্রত্যেক জিম্মিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।

লিবিয়ার নিন্দা

এদিকে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার বিষয়ে কঠোর নিন্দা জানিয়েছে লিবিয়ার সরকার। লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো শোক বার্তায় এ নিন্দা জানানো হয়েছে।

সোমবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এ হত্যাকাণ্ডকে কাপুরুষোচিত কাজ উল্লেখ করে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনারও অঙ্গীকার করেছে লিবিয়া সরকার। নিহতদের পরিবার ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে এ বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ জানানো হবে বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।