লিবিয়ায় বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ড: কিশোরগঞ্জে চার মানব পাচারকারী আটক
2020.06.03
ঢাকা

লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশি ও জীবিত উদ্ধার হওয়া ১২ জনকে পাচারের ঘটনায় আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব। মঙ্গলবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের কোম্পানি অধিনায়ক রফিউদ্দিন যোবায়ের এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভৈরবের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে মঙ্গলবার রাতে তাঁদের আটক করা হয়। এদের মধ্যে তিনজন মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত দালাল এবং একজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে।”
এদিকে একই ঘটনায় ঢাকায় একটি মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বেনারকে জানান, মঙ্গলবার রাতে সিআইডির এসআই রাশেদ ফজল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
সিআইডি'র মিডিয়ার শাখার কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, মোট ৩৮ জনকে আসামি করে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে এবং হত্যার অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে।
এর আগে একই ঘটনায় মাদারীপুরের রাজৈর থানায় দুটি, সদর থানায় একটি ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় একটিসহ মোট চারটি মামলা করেন নিহতদের স্বজনেরা। এসব মামলায় মাদারীপুরে দুইজন ও ভৈরবে একজনেকে আটক করেছে পুলিশ। মাদারীপুরে আটকৃত একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি পুলিশের তত্ত্বাবধানে হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন।
উল্লেখ্য, গত ২৮ মে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের মিজদাহ শহরে মানব পাচারকারী চক্র ও তাঁদের সহযোগীদের বন্দুক হামলায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় আরো ১১ জন বাংলাদেশি আহত এবং একজন পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন।
দেশে মানব পাচারকারী গ্রেপ্তারের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বেনারকে বলেন, “২০১৫ সাল থেকে লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ থাকার পরেও পাচারকারীরা দেশটিতে মানব পাচার করছে। যেসব বাংলাদেশি পাচারকারী এসবের সাথে জড়িত তাঁদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।”
“অল্প যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি না করলে পাচারের প্রবণতা কমবে না। পাশাপাশি অবৈধপথে যারা যাচ্ছেন, তাদেরকেও সচেতন হতে হবে,” বলেন তিনি।
আটক যারা
লিবিয়ায় হতাহতদের ঘটনায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে যাদের আটক করা হয়েছে, তারা হলেন ভৈরবের শম্ভুপুর গ্রামের হেলাল মিয়া ওরফে হেলু (৪৫), তাতারকান্দি গ্রামের খবির উদ্দিন (৪২), লক্ষ্মীপুর গ্রামের শহিদ মিয়া (৬১) এবং শম্ভুপুর গ্রামের মুন্নি আক্তার রুপসী (২৫)।
আটকের সময় তাঁদের কাছ থেকে মানবপাচার সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করা হয় বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা রফিউদ্দিন যোবায়ের।
অধিনায়ক রফিকউদ্দিন যোবায়ের বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, মানবপাচারকারী চক্রের হোতা তানজিরুল ওরফে তানজিদসহ আটক হেলাল মিয়া ওরফে হেলু, খবির উদ্দিন এবং শহিদ মিয়াসহ অন্যান্য দালালদের মাধ্যমে লিবিয়ায় নিহত পাঁচজন এবং আহত দুইজনকে তাঁরা দেশটিতে পাঠান। এদের কাছ থেকে জন প্রতি তিন-চার লাখ পর্যন্ত আদায় করে এই চক্র।
রফিউদ্দিন যোবায়ের বলেন, এই বাংলাদেশিদের ইউরোপের প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে যাওয়ার পরে দালাল চক্র তাঁদের স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে।
র্যাব জানায়, লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের হাতে নিহতদের ৬ জন এবং আহত ৪ জন ভৈরবের বাসিন্দা।
সিআইডির মামলায় গ্রেপ্তার তিন
পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান, সিআইডির করা মামলায় আসামি হিসেবে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও অজ্ঞাত আরো ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সিআইডি'র মিডিয়ার শাখার কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশি হতাহতের ঘটনায় করা মামলায় ৩৮ জন আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনজন আটক হয়েছে।
“এ বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে,” বলেন তিনি।
জানা যায়, দুদিন আগে ঢাকায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার কামাল হোসের ওরফে হাজী কামালকে (৫৫) এই মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
লিবিয়ায় বন্দি আরো ১৯ বাংলাদেশি
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বেনারকে জানান, দেশটিতে আরো ১৯ বাংলাদেশি পাচারকারীদের হাতে বন্দি রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তাঁদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
ড. মোমেন বলেন, “লিবিয়ায় আমাদের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে আরো জানতে পেরেছি সেখানে ১৯ জন বাংলাদেশিকে ত্রিপলী থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে একটি স্থানে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন চালাচ্ছে মানব পাচারকারীরা।”
অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার অন্যতম রুট যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় অনেক বাংলাদেশি আটক থাকতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আপাতত ১৯ জনের ব্যাপারে তথ্য পেয়েছি। সেখানকার কয়েকজন বাংলাদেশি এ তথ্য দূতাবাসকে দিয়েছেন। তবে তাঁদের কীভাবে উদ্ধার করা যাবে জানি না।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “নিশ্চয় পাচারকারীরা বা তাঁদের এদেশীয় এজেন্টরা আটক বাংলাদেশিদের পরিবারের সাথে টাকার জন্য দেন-দরবার করছে। এসব পরিবারের উচিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা। অন্যথায় পাচারকারীদের বিষয়ে কিছুই জানা যাবে না।”