ইউরোপে অবৈধ বাংলাদেশি: প্রায় এক লাখের মধ্যে ফিরেছেন ১৯০

জেসমিন পাপড়ি ও শরীফ খিয়াম
2019.07.10
ঢাকা
190710_BD_EU_maigrant _1000.jpg গ্রিসে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়ার দাবিতে মেসিডোনিয়ার জেভজেলিজা সীমান্তে বাংলাদেশি অভিবাসী ও শরণার্থীদের বিক্ষোভ। ২৩ নভেম্বর ২০১৫।
[এএফপি]

ইউরোপে বসবাসকারী প্রায় এক লাখ অবৈধ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাথে সমঝোতা করেছিল বাংলাদেশ, কিন্তু সেই সমঝোতার আওতায় এখন পর্যন্ত দুই’শ জনও দেশে ফেরেননি।

কর্মকর্তারা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলোর আইন অভিবাসন প্রত্যাশীদের পক্ষে হওয়ায় বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি গতি পাচ্ছে না।

“ইউরোপ থেকে অবৈধ বাংলাদেশিরা ফিরে আসছে না, সেখানকার বিদ্যমান ইমিগ্রেশন আইনের কারণেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো গাফিলতি নেই,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীর।

তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে ইইউ’র ওয়ার্কিং গ্রুপের সাথে তিনটি বৈঠক হয়েছে, যার দুটি ব্রাসেলসে এবং একটি ঢাকায়। পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে ইইউ সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

বিগত বছরগুলোতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ওই ‘এসওপি’ সইয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল ইইউ।

তখন ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ‘ইউরোস্ট্যাট’ বলেছিল, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আট বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন।

এর প্রেক্ষিতে ইইউ’র ২৮টি দেশ থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে ইইউর সাথে স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। তবে এখন পর্যন্ত সেই এসওপির আওতায় দেশে ফিরেছেন মাত্র ১৯০ জন।

“সংশ্লিষ্ট দেশ আইনি প্রক্রিয়া শেষ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশিরা ফিরতে পারবে না। যাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, তারাই ফেরত এসেছেন,” বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা খাস্তগীর।

এদিকে “বাংলাদেশ ও ইইউ উভয়পক্ষই এসওপির নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় কাজ করে যাচ্ছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ব্রাসেলস-এ এসওপি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে যোগদান করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুনিম হাসান।

তিনি বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন মানবাধিকারের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ফলে কোনো অবৈধ অভিবাসীকে প্রত্যাবাসনের আগে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করে।”

“এছাড়া এসওপি বাস্তবায়নের প্রতিটা ধাপে অভিবাসীদের পক্ষে সুযোগ রয়েছে। ফলে একজন অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর জন্য কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে,” বলেন মুনিম হাসান।

সঠিক সংখ্যা জানা নেই

ইউরোপে অবস্থানকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের বর্তমান সংখ্যা সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

এসওপির ধীর গতি এবং ইউরোপে অবস্থানকারী অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশে ইইউ রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিংককে ইমেইল পাঠানো হয়।

ইমেইলের জবাবে ইইউ’র বাংলাদেশ অফিসের জ্যেষ্ঠ কার্যক্রম কর্মকর্তা (গণমাধ্যম ও যোগাযোগ) আনজুম আজিজ বেনার প্রতিনিধিকে এসব তথ্যের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

তবে খোরশেদ আলম খাস্তগীর জানান, “এই মুহূর্তে ইউরোপে কত সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি আছে তার সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই। তাদের (ইউরোস্ট্যাট) ‘সিস্টেম’ থেকে একেক সময় একেক সংখ্যা জানানো হয়, যার ‘অফিশিয়াল’ ভিত্তি নেই।”

“ইউরোপের দেশগুলোর কোনো ‘বর্ডার’ নেই। যাকে এক দেশ ‘কাউন্ট’ করছে তাঁকে অন্য দেশও কাউন্ট করে। তাই সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না,” যোগ করেন তিনি।

মূল গন্তব্য ইতালি, সেখান থেকে ফেরতও আসেনি কেউ

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শুরুতে ডিঙি নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়া লোকজনের মধ্যে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশের নাগরিকেরা। সে বছর প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের দুই হাজার ৮০০ জন নাগরিক এভাবে ইতালিতে গিয়েছিলেন।

এখন পর্যন্ত এটাই অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার প্রধান পথ উল্লেখ করে খোরশেদ আলম খাস্তগীর বলেন, “আশার কথা হচ্ছে এ বছর ইতালিতে বাংলাদেশি প্রবেশের হার কমেছে। গত বছর প্রবেশ করেছিল নয় হাজার, এ বছর বড়জোর দুইশ। এ কারণে সাম্প্রতিক বৈঠকে ইতালি সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।”

তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ওয়েবসাইটে ২০ ও ১৮ জুন প্রকাশিত দুটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরেরর ৩১ মে পর্যন্ত অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালিতে প্রবেশ করা বাংলাদেশির সংখ্যা ১৪৫ জন।

“সমুদ্রপথে ইতালি পৌঁছানো মানুষের সংখ্যা এখন একদম কমে গেছে,” বেনারকে বলেন রোম দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের পরামর্শক (স্থানীয়) পদে দায়িত্বরত মো. আরফানুল হক।

তবে অনেক ক্ষেত্রেই অভিবাসীদের জাতীয়তা চিহ্নিতকরণ সমস্যার কারণে তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা নির্ধারণ বেশ কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“অভিবাসন প্রত্যাশীরা নৌকায় ওঠার পর বা নৌকা থেকে তীরে নামার আগেই পরিচয় সংক্রান্ত সব নথি ফেলে দেয়। ফলে তাদের জাতীয়তা চিহ্নিত করার মতো কিছুই থাকে না,” বলেন তিনি।

একইভাবে গত মাসে আরও এক হাজার ২৭৩ জন ইতালি ঢুকলেও তাদের কত জন বাংলাদেশি তা এখনো জানায়নি ইউএনএইচসিআর।

সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয়ে এ বিষয়ক কোনো তথ্য নেই বলে বেনারকে জানান ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা।

“যতক্ষণ কেউ ‘অবৈধ অভিবাসী’ থাকেন, ততক্ষণ আইওএম তাদের দেখভাল করে। যখন তারা আশ্রয়প্রার্থী হন, তখন দায়িত্ব নেয় ইউএনএইচসিআর,” বেনারকে বলেন জোসেফ।

এদিকে ইাতলিতে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে গেছেন। তবে এসওপির আওতায় এখন পর্যন্ত কেউ ইতালি থেকে দেশে ফিরে যাননি বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশের রোম দূতাবাসের শ্রম পরামর্শক আরফানুল হক।

তিনি জানান, ইতালিতে অবৈধভাবে প্রবেশকারী বা বৈধতা হারানো বাংলাদেশিরা কেউ অর্থনৈতিক, আবার কেউবা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে সেখানে রয়েছেন।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোম দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, এই মুহূর্তে ইতালিতে প্রায় দেড় লাখের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন।

ফিরে আসাদের পুনর্বাসন

ইউরোপ থেকে ফেরত আসা অভিবাসীদের পুনর্বাসনে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এবং আইওএম যৌথভাবে ‘প্রত্যাশা’ নামে তিন বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। এর আওতায় গত দুই বছরে ৪২৮ জন ইউরোপ ফেরত বাংলাদেশিকে জরুরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে জানান, এর মধ্যে জার্মানি থেকে ১০৪, গ্রিস থেকে ১৩১, ইতালি থেকে ৯২, যুক্তরাজ্য থেকে ১৬, ফ্রান্স থেকে নয়, সাইপ্রাস থেকেও নয়, অস্ট্রিয়া থেকে চার এবং বেলজিয়াম থেকে দুজন করে ফেরত এসেছেন।

এছাড়া পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, লাটভিয়া, ও এস্তোনিয়া থেকেও দেশে ফিরেছেন কয়েকজন বাংলাদেশি।

“যেসব অবৈধ বাংলাদেশি স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসেন, ইউরোপে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয় না। বরং কয়েক বছর পরে তাদের আবার বৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ থাকে,” বলেন শরিফুল হাসান।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।