ঈদের দিন ভূমধ্যসাগরে ডুবে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু
2021.07.22
ঢাকা

লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে কমপক্ষে ১৭ জন বাংলাদেশি মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্ঘটনার তথ্য বৃহস্পতিবার বেনারকে নিশ্চিত করেছেন লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির।
ঈদের দিন (বুধবার) তিউনিসিয়ার উপকূলে ওই দুর্ঘটনার পর সাগর থেকে অন্তত ৩৮০ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে দেশটির কোস্টগার্ড। এই তথ্য জানিয়ে আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এদের মধ্যে ৬২ জন বাংলাদেশি রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে জীবিত বা মৃত কারও পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।”
আসাদুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তিউনিশিয়ায় কঠোর লকডাউন চলছে। লিবিয়ার সাথে দেশটির বর্ডার সিল করা রয়েছে। এমন অবস্থায় তিউনিশিয়ায় গিয়ে এসব বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেখা করা বা তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ নেই।”
“তবে রেড ক্রিসেন্টসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের আপাতত কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হবে। তারপর তাদের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) শেল্টার হাউজগুলোতে রাখা হবে। সেখান থেকে ধীরে ধরে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে,” বলেন তিনি।
“নিহত ১৭ বাংলাদেশির মরদেহ তিউনিশিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। তাদের সেখানেই দাফন করা হতে পারে। কারণ, বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই তাদের মরদেহ দেশে আনা সম্ভব নয়,” বলেন আসাদুজ্জামান।
তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, বাংলাদেশি ছাড়া নৌকাটি থেকে উদ্ধার হওয়া অন্যান্যরা সিরিয়া, মিসর, সুদান ও মালির অভিবাসী। এসব অভিবাসীদের বহনকারী নৌকা লিবিয়ার উত্তরপশ্চিম উপকূলের জুয়ারা থেকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপের দেশ ইতালিতে যাচ্ছিল। তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে।
তিউনিসিয়া রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী যারা মারা গেছে তাদের সবাই নৌকার ভেতরে ছিলেন। কারণ তারা পাচারকারীদের অন্যদের চেয়ে কম টাকা দিয়েছিল। ফলে ইঞ্জিনে আগুন লাগলে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে তারা মারা যায়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিউনিসিয়ার উপকূলে বেশ কয়েকটি নৌযানডুবির ঘটনা ঘটেছে।
আসাদুজ্জামান কবিরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, চলতি জুন এবং গত মে মাসেই ভূমধ্যসাগর থেকে সাত শতাধিক বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে সেখানকার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
গত ২৪ জুন তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড ভূমধ্যসাগর থেকে ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে, তাঁদের ২৬৪ জনই ছিলেন বাংলাদেশি। বাকি তিনজন মিসরের নাগরিক।
এর আগে গত ১০ জুন তিউনিসিয়া উপকূল থেকে ১৬৪ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে দেশটির কোস্টগার্ড। এ ছাড়া গত ১৮ মে ৩৬ জন এবং ২৭ ও ২৮ মে উপকূল থেকে ২৪৩ বাংলাদেশিকে উদ্ধার হয়।
আসাদুজ্জামান কবির বলেন, বিপদসঙ্কুল পথ জেনেও এরা দালালের সহায়তার লিবিয়া ও তিউনিশিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ইতালিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এর সাথে বিরাট একটি চক্র জড়িত বলে মনে করেন সরকারের এই কর্মকর্তা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “লিবিয়ায় ঠিক কতজন বাংলাদেশি উদ্ধার হয়েছে তা বলা মুশকিল। কারণ, লিবিয়ায় উদ্ধার হওয়া সবাইকে ডিটেনশন (কারাগার) সেন্টারে রাখা হয়। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারাগার কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তাদের সাথে দেখা করা সম্ভব হয় না।”
বেসরকারি সংস্থা জাস্টিস এন্ড কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. তারিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “করোনা মহামারীর সময়ে কর্মসংস্থান কমে গেছে। এ ছাড়া উঠতি বয়সের কিছু যুবক আছে কমিউনিটি থেকে যারা অভিবাসী হওয়ার আকাঙ্খা নিয়েই বড় হয়। লোকাল এমপ্লয়মেন্টের জন্য যে যোগ্যতা থাকা দরকার, তা তাদরে নেই। ফলে তারা যেকোনোভাবে বিদেশে যেতে চায়।”
“ইতালি বা ইউরোপের দেশগুলোতে করোনা পরিস্থিতি যখন বেশি খারাপ ছিল, তখন এদিক থেকে যাওয়ার পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু ইউরোপ মহামারী কিছুটা ম্যানেজ করে ফেলেছে। তাই আবার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ওদিকের ক্রিমিনাল নেটওয়ার্কও হয়তো গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে,” মনে করেন তিনি।
তারিকুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ থেকে টুরিস্ট ভিসা দিয়ে আগ্রহীদের একটি ট্রানজিট কান্ট্রিতে পাঠানো হয়। ট্রানজিট হিসেবে এখন জনপ্রিয় দেশ হচ্ছে দুবাই। সেখান থেকে অন্যান্য দেশ হয়ে তারা লিবিয়ায় পৌঁছায়। লিবিয়া থেকে দালালরা তাদের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে সাহায্য করে।”
“এ ক্ষেত্রে সবাই ব্যর্থ হয়, তা কিন্তু নয়। অনেকে কিন্তু ইউরোপে পৌঁছায়। আর তারাই দেশে থাকা আরো তরুণদের কাছে উদাহরণ হয়ে যায় এবং এই ঝুঁকি নিতে উদ্বুদ্ধ করে,” বলেন তিনি।
“এই মহামারির মধ্যে সংশ্লিষ্ট ক্রিমিনাল নেটওয়ার্ক খুবই সক্রিয় রয়েছে। আবার এসব ঘটনার বেশির ভাগের বিচার হয় পাচার আইনে, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ওই আইনে এসব ঘটনা প্রমাণ করা যাচ্ছে না,” বলেন ওই বিশেষজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, “সাধারণত এসব পাচারকারী পয়সাওয়ালা মানুষ। ফলে তারা আইনের ফাঁক দিয়ে দ্রুত বের হয়ে আসে এবং আবার একই অপরাধ করে। তা ছাড়া যেভাবে মানুষকে সতর্ক করা হয় তার চেয়ে প্রলোভনের ভাষা ওদের কাছে বেশি শক্তিশালী,” বলেন তারিকুল ইসলাম।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০ হাজার মানুষ ইতালিতে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে তালিকার শীর্ষে থাকা আড়াই হাজারের বেশি বাংলাদেশি ইউরোপে পৌঁছেছে।
এ ছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে আট শতাধিক অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)।