ভারত ও বাংলাদেশে গ্রেপ্তার সাত জঙ্গির পাঁচজনই নব্য জেএমবির

পরিতোষ পাল ও শরীফ খিয়াম
2021.07.12
কলকাতা ও ঢাকা
ভারত ও বাংলাদেশে গ্রেপ্তার সাত জঙ্গির পাঁচজনই নব্য জেএমবির নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে একটি জঙ্গি আস্তানা থেকে ডেটোনেটরসহ শক্তিশালী বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়, এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে দুই জঙ্গি। জুলাই ১১, ২০২১।
ফোকাস বাংলা

ভারত ও বাংলাদেশে একইদিনে সাত জঙ্গিকে আটকের কথা জানিয়েছে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যাদের মধ্যে পাঁচজনই নব্য জেএমবি’র (জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) সদস্য। জেএমবি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুসারী বলে পরিচিত।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতা এবং ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জেএমবি সদস্যদের। এ ছাড়া ভারতের উত্তর প্রদেশের লখনৌ থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে আল-কায়েদাপন্থী দুই জঙ্গি।

রবিবার আটক হওয়া এই সাতজনকে সোমবার আদালতের মাধ্যমে রিমাণ্ডে নেওয়া হয়েছে। এর আগে দুই দেশেই পাওয়া গেছে বিপুল বিস্ফোরকসহ বোমা তৈরীর কারখানা।

দুই দেশের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে আল-কায়েদাপন্থীদের বোমার লক্ষ্য ছিল দেশটির বিভিন্ন জনাকীর্ণ শহরে হামলা করা। আর বাংলাদেশে আইএস মডিউলে তৈরী বিস্ফোরকের লক্ষ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) রবিবার দুপুরে নাজিঊর রহমান পাভেল ওরফে জয়রাম ব্যাপারি ওরফে জোসেফ (৩০), মিখাইল খান ওরফে শেখ সাব্বির (৩০) ও রবিউল ইসলাম (২২) নামের তিন জঙ্গিকে আটক করে। দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুরের একটি বাসা থেকে আটক হওয়া এই তিনজনের বাড়িই বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলায়।

এসটিএফ-এর যুগ্ম কমিশনার ভি সলোমন নেসাকুমার সাংবাদিকদের জানান, তাদের সঙ্গে জেএমবি’র যোগাযোগ রয়েছে। বেশ কিছু জিহাদি নথি, জাল ভারতীয় পরিচয়পত্র ও একটি ডায়েরি পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ডায়েরিতে আইএস নেতাদের নামও পাওয়া গেছে।”

এসটিএফ-এর ডেপুটি কমিশনার অপরাজিতা রাই বলেন, “তারা কীভাবে এখানে এসেছে, নাশকতা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কিনা এবং তাঁদের পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে কারা সাহায্য করেছে—এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে পুলিশ।”

বাংলাদেশের শীর্ষ জেএমবি নেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন অপরিজিতা।

পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে সোমবার তাদের প্রত্যেকের ১৪ দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছে কলকাতার নগর দায়রা আদালত। শুনানিতে পুলিশ জানায়, সেলিম মুন্সী নামের আরো এক জঙ্গি পলাতক রয়েছে। এসটিএফ-এর দাবি, বাংলাদেশের কাশিমপুর কারাগারে বন্দী এক জঙ্গি নেতার নির্দেশে জেএমবির ১৫ সদস্যের একটি দল তিন ভাগে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এই দলটি কলকাতা এলেও অন্য দুটি দল ওড়িশা ও জম্মু কাশ্মীরে গেছে বলে জানতে পেরেছে তারা।

কলকাতা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আটককৃতদের বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করছেন তারা। বেনারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলেও কোনো জবাব দেয়নি বাংলাদেশের পুলিশ সদর দপ্তর।

তবে সোমবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “তাদের আটকের তথ্য পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা এ বিষয়ে যোগাযোগ করব।”

কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া নাজিউর বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছিল। এর আগে সে বিস্ফোরকসহ গ্রেপ্তার হয়ে বাংলাদেশের কারাগারে ছিল।

একইদিনে উত্তর প্রদেশ পুলিশের এটিএস (সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড) লখনৌ থেকে আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট দুইজনকে আটক করেছে। সোমবার তাদের আদালতে পেশ করার হলে ১৪ দিন করে রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন বিচারক।

রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত মহানির্দেশ প্রশান্ত কুমার সংবাদ সম্মেলনে জানান, মিনহাজ আহমেদ ও মাসিরউদ্দিন নামে ওই দুই ব্যক্তি আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ নামের জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য। ১৫ আগস্টের স্বাধীনতা দিবসে ঘিরে লখনৌসহ বিভিন্ন জনাকীর্ণ স্থানে হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। 

“এই উদ্দেশে তারা অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করছিল। তাদের গ্রেপ্তাদের মাধ্যমে নাশকতা বানচাল করা সম্ভব হয়েছে,” বলেন তিনি।


বাংলাদেশেও বোমা তৈরীর কারখানা

ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে রবিবার বিকেলে সিটিটিসি-র হাতে আটক হওয়া নব্য জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলার ছিল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের পাঁচগাও এলাকার মিয়াবাড়ি জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন; থাকত পাশেরই একটি ঘরে। 

“প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মামুন স্বীকার করেছে, সেখানে আইএস অনুপ্রাণিত আইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরি করতো সে,” সাংবাদিকদের বলেন সিটিটিসির বোমা উদ্ধার ও নিস্ক্রিয়করণ টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার এ কে এম রহমতউল্লাহ সুমন।

একইদিন রাতে কেরানীগঞ্জ থেকে আটক হওয়া নব্য জেএমবির আরেক সদস্য মো. কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামা ছিল একই জেলার মদনপুরের কাজীপাড়া এলাকার একটি মসজিদের ইমাম।

“তিনিও সামরিক শাখার সদস্য এবং বোমা তৈরির দক্ষ কারিগর ও প্রশিক্ষক,” ব্রিফিংয়ে বলেন সিটিটিসি প্রধান।

এই দুই জঙ্গির বাসস্থানেই বোমা তৈরীর কারখানার সন্ধান পায় সিটিটিসি।

মামুনের আড়াইহাজারের নোয়াগাঁও এলাকার বাড়িটি থেকে ডেটোনেটরসহ শক্তিশালী বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের মাধ্যমে তিনটি বোমা নিষ্ক্রিয় করার পর অতিরিক্ত উপকমিশনার সুমন বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিদের ব্যবহার করা যে কোনো বোমার তুলনায় এগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।”

ওসামার মদনপুরের বাসায় পূর্ণাঙ্গ বোমা না পাওয়া গেলেও শক্তিশালী আইইডি তৈরির সামগ্রী পাওয়া গেছে।

“এই বাসায় সে সপরিবারে থাকত। কয়েকদিন আগে পরিবারকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে একা একা বোমা তৈরি শুরু করেছিল,” বলেন আসাদুজ্জামান। 

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সোমবার বিকেলের সংবাদ সম্মেলনে  সিটিটিসি প্রধান জানান, ওসামা বাংলাদেশের নব্য জেএমবির আমীর মাহাদী হাসান ওরফে আবু আব্বাস আল বাঙ্গালীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। সামরিক শাখার অন্যান্য সদস্যদের সাথে অনলাইনে ও অফলাইনে যোগাযোগ রক্ষা করে সে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ দিত।

“তথাকথিত ওই আমিরের নির্দেশে ‘স্লিপার সেল’ হিসেবে কাজ করত তারা। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করা। এরই অংশ হিসেবে গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড সংলগ্ন পুলিশ বক্সে বোমা রেখে এসেছিল তারা,” বলেন তিনি।

ওই দুই জঙ্গিকে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।

 

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব কনফিক্ট, ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসের (আইসিএলডিএস) নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে এই অঞ্চলের জঙ্গিরা।”

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর সেখানে তালেবানদের পুনুরুত্থান এবং এই অঞ্চলে কোভিড পরবর্তী নতুন ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ জঙ্গিদের নতুন পৃষ্ঠপোষক পাওয়ার পথ সুগম করেছে বলে অভিমত এই বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষকের।  

“ভূরাজনীতিতে আধিপাত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে চায়, তারাই জঙ্গিদের অর্থায়ন শুরু করেছে,” বলেন আব্দুর রশীদ।

তিনি মনে করেন, এই সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশ, ভারতসহ জঙ্গি বিরোধী রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। 

ভারতীয় বিশ্লেষক অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ বেনারকে বলেন, ভারতে কিছুদিন ধরেই জেএমবি জঙ্গিদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।

“বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো অনেক দিন ধরেই সক্রিয়। তবে হাসিনা সরকার জঙ্গি দমনে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে এই গোষ্ঠীগুলো প্রতিবেশি ভারতে এসে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্ত্র ও বিস্ফোরকও যাচ্ছে।”
কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই শিক্ষক মনে করেন, পুলিশ প্রশাসনের শৈথিল্যের সুযোগ নিয়েই জঙ্গিরা তাদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তাই সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।

২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের সংসদে মন্ত্রী জি কিষেন রেড্ডি জানান, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মোট ১২০ জন জেএমবি জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু আসামে ৫৯ জন ও পশ্চিমবঙ্গেই ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

কলকাতা পুলিশের এসটিএফ জানিয়েছে, গত দেড় বছরে তারা আরো সাত জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।