আনসার আল ইসলামের ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ নিখোঁজ হওয়ার পর গ্রেপ্তার
2021.07.16
ঢাকা

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ মাহমুদ হাসান গুনবী ওরফে হাসানকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে র্যাব, গত দশদিন নিখোঁজ ছিল সে।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শাহ আলী থানার বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে শুক্রবার র্যাবের মিডিয়া উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। গুনবী সাধারণ জঙ্গিদের আত্মঘাতী হতে উদ্বুদ্ধ করত বলে জানিয়েছে র্যাব।
বিকেলে রাজধানীর কাওরানবাজারে মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন বলেন, আনসার আল ইসলামের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণে গুনবীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষক পরিচয়ের আড়ালে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়ে সে জঙ্গিবাদের প্রচারণা এবং জঙ্গিদের রিক্রুট করতো।
তাকে ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ বলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গুনবীর বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অনেক। জঙ্গিদের কাছে গুনবী ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ হিসেবে পরিচিত। বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের মতাদর্শ পরিবর্তন করার ক্ষমতা তার মধ্যে আছে।”
অবশ্য গুনবীর পরিবারের দাবি, গত ৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়েছে। তার স্বজনেরা তুলে নেওয়ার অভিযোগ করে কদিন আগে নেত্রকোনায় সংবাদ সম্মেলন করে।
তবে এ বিষয়ে মঈন বলেন, সে আত্মগোপনে ছিল। গতকালই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বেনারকে বলেন, সশস্ত্র জঙ্গিবাদের শিকড় হলো এই মাহমুদুল হাসান গুনবীর মতো জঙ্গি নেতারা, যারা ধর্মের অপব্যখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করে; মানুষকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে।”
এদের নেটওয়ার্ক এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মানুষ সাধারণতই ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল। আমাদের দেশের মুসলমানরা আরও বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও বিচার বুদ্ধি বিশ্লেষণ কম। এই সুযোগ নিয়ে এই ধরনের ব্যক্তিরা নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।”
দেশের সকল মাদ্রাসাকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করলে জঙ্গিবাদের শঙ্কা আরো বাড়বে বলে মনে করেন মোহাম্মদ আলী শিকদার।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক জানান, মাহমুদুল হাসান নিজের মোটিভেশনাল শক্তির মাধ্যমে অন্য ধর্মের অনেককেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করত।
“গুনবী ‘দাওয়াত ইসলাম’-এর ব্যানারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদে যুক্ত করার বিশেষ উদ্যোগ নেয়। সে মাহফিলের আড়ালে জঙ্গি সদস্য সংগ্রহ করত,” বলেন তিনি।
সম্প্রতি আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য ওসামা এবং সাকিবকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব গুনবী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় বলে জানান খন্দকার মঈন।
“তাদের গ্রেপ্তারের পর জানা যায় সংসদ এলাকায় জড়ো হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। এ বিষয়ে গুনবীর সম্পৃক্ততা না পেলেও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সদস্য বাড়াতে বিভিন্ন উগ্রবাদী মতবাদ প্রচারের বিষয়টি নিশ্চিত হয় র্যাব,” বলেন তিনি।
গুনবী ২০১৪ সাল থেকে ধর্মীয় বক্তব্যে উগ্রবাদিত্ব প্রচারে নিজেকে সম্পৃক্ত করে—এমন দাবি করে র্যাব মুখপাত্র বলেন, গুনবী প্রথমে জঙ্গি সংগঠন হুজি (বি) সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে জঙ্গি নেতা জসীমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সে আনসার আল ইসলাম বাংলা টিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। জসিম উদ্দিন রহমানী গ্রেপ্তারের পর সে পক্ষপাতিত্ব প্রচারক হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে।
র্যাব জানায়, খাগড়াছড়িতে গুনবীর একটি মাদ্রাসা রয়েছে। অনেককে সেখানে নিয়ে যেত সে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় সে উগ্রবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাহফিলে বক্তব্য দিতো। উত্তরবঙ্গ হয়ে দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা ছিল তার।
খন্দকার মঈন বলেন, “বাংলাদেশকে উগ্রবাদী রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে উগ্র মতাদর্শ প্রচার, পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্টদের সাথে বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠক করেছে মাহমুদুল হাসান। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সুযোগ সন্ধানের অপপ্রয়াসও চালিয়েছে সে।”
এই র্যাব কর্মকর্তা জানান, গুনবী হেফাজতের কোনও কমিটিতে বা পদে ছিল না। তবে হেফাজতের বিভিন্ন কর্মসূচীতে সে অংশ নিয়েছে। নিজেকে জাহির করতে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল সে।
র্যাব জানায়, গুনবী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস পড়ে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সজারের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করে। পাশাপাশি ধর্মীয় মতাদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়। ২০১০ সাল থেকে গুনবী ওয়াজ মাহফিল শুরু করে। ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসার সঙ্গেও সে জড়িত ছিল।
এর আগে এপ্রিলে রাজধানীর পল্টন থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আনসার আল ইসলামের আইটি বিভাগের প্রধানসহ দুই সদস্য আরিফুল ইসলাম জাহেদ ওরফে আইমান ওরফে আরাহান ওরফে রেহান (৩০) এবং বাকিবিল্লাহ ওরফে আবু সামির ওরফে জাফর ওরফে ফয়সালকে (৩৪) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত মে মাসে খুলনা থেকে আনসার আল ইসলামের চার সদস্যকে আটক করা হয়।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত আনসার আল ইসলামের ৮৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে খন্দকার মঈন বলেন, “সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে আনসার আল ইসলামের সদস্যরাই বেশি ধরা পড়ছে, যারা উগ্রবাদী মতবাদ উসকে দিচ্ছে।”
জেএমবি সদস্যের ফাঁসি কার্যকর
প্রায় ১৬ বছর আগে নেত্রকোণায় উদীচীর কার্যালয়ে বোমা হামলার আসামি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য আসাদুজ্জামান চৌধুরী ওরফে পনিরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টা এক মিনিটে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয় বলে নিশ্চিত করেন কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. গিয়াস উদ্দিন।
২০১৯ সালের নভেম্বরে পনিরের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন সর্বোচ্চ আদালত খারিজ করে দেয়।
জেল সুপার সাংবাদিকদের বলেন, “ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে পনিরের লাশ রাতেই পুলিশ পাহারায় তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।”
পনিরের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন।
এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, “রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল যে, দেশের মানুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত নৃশংস হামলা ও হত্যাকাণ্ডের হোতাদের এমন শাস্তি পেতে হবে।”
তবে তারা বলেন, “আমরা এখনও শঙ্কিত এ কারণে যে, এদেশ থেকে এখনো জঙ্গিগোষ্ঠীর মূলোৎপাটন সম্ভব হয়নি। যে সাম্প্রদায়িক উগ্র চিন্তা এবং আদর্শিক ভিত্তির উপর এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিকশিত হয়, তা আজও আমাদের সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, “একজন জঙ্গিকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এটা ভালো দৃষ্টান্ত, তবে ১৬ বছর সময় লাগাটা অস্বাভাবিক।”
২০০৫ সালের ৬ ডিসেম্বর নেত্রকোনার উদীচী ও শতদল শিল্পী গোষ্ঠীর কার্যালয়ে চালানো আত্মঘাতী বোমা হামলায় আটজন নিহত ও ৪০ জন আহত হন।