জঙ্গিদের সক্ষমতা বেড়েছে, বড় হামলার আশঙ্কা থাকলেও পুলিশ যথেষ্ট সতর্ক
2021.07.20
ঢাকা
বাংলাদেশে জঙ্গিদের সক্ষমতা বেড়েছে বলে মনে করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তাই জঙ্গি হামলার আশঙ্কা প্রকাশের পাশাপাশি পুলিশ যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম।
মঙ্গলবার দুপুরে ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ডিএমপি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মহানগর পুলিশের প্রধান বলেন, “সম্প্রতি যেসব বোমা উদ্ধার হচ্ছে সেগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। এগুলো বিস্ফোরণ ঘটলে একটা ম্যাসাকার হয়ে যেতে পারে।”
বিষয়টি বিস্তারিত জানতে পুলিশের বোমা নিস্ক্রিয়কারী দলের সদস্য ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার (অপারেশনস) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “কমিশনার স্যার যে কথা বলেছেন তা সত্য। বর্তমানে জঙ্গিরা বোমা বানানোর ক্ষেত্রে ট্রিগারিং পাওয়ার উন্নত করেছে। আগের বোমাগুলোতে ট্রিগারিং পাওয়ার তেমন বেশি ছিল না।”
বেনারকে তিনি বলেন, “জঙ্গিরা আগের মতো উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক ব্যবহার করতে পারে না। কারণ আমরা এগুলোর সহজলভ্যতা বন্ধ করে দিয়েছি। সেকারণে তারা কিছু লো-গ্রেড বিস্ফোরক ব্যবহার করে থাকে। এই লো-গ্রেড বিস্ফোরকের সাথে তারা কিছু বাড়তি জ্বালানি ধরনের পদার্থ ব্যবহার করে। ফলে এই বোমাগুলো বিস্ফোরিত হলে আশেপাশে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
ছানোয়ার হোসেন বলেন, “তবে এই ধরনের লো-গ্রেড বিস্ফোরককে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া খুব বিপজ্জনক। আবার এগুলো যে সময়মতো বিস্ফোরিত হবে তারও নিশ্চয়তা নেই।”
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেছেন, “বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে আফগানিস্তানের ঘটনার মারাত্নক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত পতনের পর বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের বিকাশ ঘটে।”
তাঁর মতে, “আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের জঙ্গিরাও আদর্শিকভাবে উদ্বুদ্ধ। সুতরাং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর পূর্ণ প্রত্যাহার হলেও বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম আবার বাড়বে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।”
ডিএমপি প্রধানের সতর্কবাণী
ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, “তাদের (জঙ্গিদের) সক্ষমতা বেড়েছে এবং তারা নতুন লোক যুক্ত করে তাদের প্রশিক্ষিত করে বোমা বানানোর কাজে নিয়োগ করতে পেরেছে। এ জন্যই আমরা মনে করছি, তাদের প্রস্তুতি আছে।”
“তবে আমরাও বসে নেই। এ বিষয়ে আমাদের যারা কাজ করছে তারা যথেষ্ট এক্সপার্ট। তাই আমরা মনে করছি না ঈদে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটবে,” আশ্বস্ত করেন তিনি।
শফিকুল ইসলাম বলেন, “খুবই সতর্ক আছি কারণ রিসেন্টলি তাদের তৎপরতা যেমন বেড়েছে তেমনি তাদের বোমা বানানোর যে সক্ষমতা, সেটিও বেশ উন্নত হয়েছে।”
“আমরা মনে করছি না কিছু হবে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের যে তৎপরতা বেড়েছে তাতে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে,” বলেন তিনি।
আগের কিছু ঘটনার তুলনা করে তিনি বলেন, “আমি কমিশনার হবার আগে রাজধানীর পাঁচটি পুলিশ চেকপোস্টে জঙ্গি বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। সেসব বোমা কিন্তু বেশি শক্তিশালী ছিল না। একেবারেই অল্প কাজ জানা লোকের হাতে তৈরি হয়েছিল। কম শক্তিশালী হওয়ায় পুলিশ সদস্যরা তেমন আহত হয়নি।”
সম্প্রতি ভারতে তিনজন বড় মাপের জঙ্গি গ্রেপ্তার হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শফিকুল ইসলাম বলেন, “তাদের সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। এই তিন জন ছেলে জিহাদের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে, এই তথ্যটা আমরা জানতাম। যেটা আমরা যথাসময়ে ভারতকে জানিয়েছি। এ ধরনের তথ্য আমরা পরস্পর আদান-প্রদান করে থাকি।”
সম্প্রতি জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, “এই কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে বাইরে যাবার সুযোগ কম, বিনোদনের সুযোগও কম। এই সময়ে অনেকেই ইন্টারনেটে বসে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছে, তথ্য উপাত্ত দেখছে ও পড়ছে। এক পর্যায়ে কেউ কেউ জঙ্গিদের ট্র্যাপে পড়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নজরদারিও কম না। কোনো কোনো ঘটনা ঘটনার আগেই আমরা খবর পেয়ে যাচ্ছি। নইলে বড় ঘটনা ঘটতে পারত।”
তবে ডিএমপি কমিশনারের এই বক্তব্যকে “একমুখী চিন্তার বহি:প্রকাশ” অভিহিত করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক আব্দুর রশীদ বলেছেন, “এ বক্তব্যে ভীতির সঞ্চার হতে পারে।”
“একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে কয়েক বছরের মধ্যে এ ধরনের কথা শুনিনি। আমার মনে হয়, তিনি জঙ্গিদের তৎপরতার ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করেছেন।”
“তবে শক্তিশালী বোমা প্রাপ্তির বিষয়ে তিনি যা বলেছেন, তা জঙ্গিবাদ বিস্তৃতির বড় কোনো দিকদর্শন নয়। কারণ জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে শুধু বোমা সক্ষমতা নির্ভর করে না,” বলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা।
“জঙ্গিদের এখন বৈদেশিক পৃষ্ঠপোষকতা নেই এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাও দৃশ্যমান নয়। কিন্তু আফাগানিস্তানে তালেবানের শক্তি বৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশের জঙ্গিরা উজ্জীবিত হতে পারে। তবে অন্যান্য শর্তগুলো পর্যালোচনায় আর কোনো সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।”
আব্দুর রশীদ বলেন, “জঙ্গিরা সব সময় মাথাচাড়া দিতে চায়। কিন্তু যখন তারা অর্থ পায়, বিদেশি শক্তির রাজনৈতিক সমর্থন পায় এবং তাদের প্রয়োজনীয় লজিস্টিক পায় তখনই তারা মাথাচাঁড়া দিতে পারে।”
সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার
১৫ জুলাই রাজধানীর মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদুল হাসান গুনবীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরদিন ১৬ জুলাই র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, “এ বছর এখন পর্যন্ত আনসার আল ইসলামের ৮৭ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে আনসার আল ইসলামের সদস্যরাই বেশি ধরা পড়ছে।”
১১ জুলাই যাত্রাবাড়ী থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং কেরানীগঞ্জ থেকে কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামা নামে দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। তারা এখন পুলিশ রিমান্ডে আছে।
এর আগে ৭ জুলাই মিরপুরের পল্লবী থেকে সাব্বির হোসেন (২১), রবিউল ইসলাম উসমান (২২) এবং নাঈম মিয়া (১৯) নামে তিন জঙ্গিকে বোমা তৈরির ম্যানুয়াল এবং বিস্ফোরক দ্রব্যসহ গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তাদের মধ্যে সাব্বির নব্য জেএমবির সামরিক শাখার আঞ্চলিক কমান্ডার। তার অধীনে অন্তত ২০ জন সক্রিয় সামরিক সদস্য আছে বলে পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।
জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত ১১ জুন থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১১ জন গ্রেপ্তার হয় যাদের প্রায় সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য।