ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় পেট্রোল বোমা হামলার চেষ্টা করা দেলোয়ার ‘লোন উলফ’
2021.09.20
ঢাকা
সিরিয়া, ইরাক, প্যালেস্টাইনসহ সারা বিশ্বে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের নীরবতায় ক্ষিপ্ত হয়ে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিকল্পনা থেকেই বৃহস্পতিবার ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত মার্কিন ও থাই দূতাবাসের কাছে পেট্রোল বোমা হামলা চালায় নিজ থেকে উগ্রপন্থী (লোন উলফ) হয়ে ওঠা আনসার আল-ইসলাম সদস্য দেলোয়ার হোসেন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কাছে এ কথা জানায় রিমান্ডে থাকা ওই জঙ্গি।
দেলোয়ারের বরাত দিয়ে সোমবার বেনারকে এই তথ্য জানান কাউন্টার টেররিজম অ্যাণ্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট প্রধান এম. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, “জঙ্গি দেলোয়ারকে আমরা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। মঙ্গলবার রিমান্ড শেষ হলে তাকে আমরা আদালতে পাঠিয়ে দেব।”
কূটনৈতিক পাড়ায় জঙ্গি হামলা চালাতে বৃহস্পতিবার দুপুরে মার্কিন ও থাই দূতাবাসের কাছে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থীদের বহন করা গাড়িতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দেলোয়ার। তবে সেই বোমা বিস্ফোরণ হয়নি, হামলায় কেউ আহত হয়নি। উপস্থিত জনতার সহয়তায় তাকে ধরে ফেলে টহল পুলিশ।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার পর এটিই ছিল ওই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রথম জঙ্গি হামলার চেষ্টা।
বৃহস্পতিবারের বোমা হামলার প্রত্যক্ষদর্শী আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ঘটনার সময় আমরা গাড়িতেই ছিলাম। হঠাৎ ওই আক্রমণকারী আমাদের গাড়িতে বোমা মারে। এরপর আশেপাশের লোকজন, পুলিশ সবাই এসে তাকে ধরে ফেলে।”
তিনি বলেন, “পুলিশ ওই আক্রমণকারীকে আটক করে নিয়ে যায়। তারা এ বিষয়ে তদন্ত করছে। এর বেশি কিছু তারা জানা নেই।”
রিমান্ডে কী জানালো জঙ্গি দেলোয়ার?
এম. আসাদুজ্জামান বলেন, “রিমান্ডে আমাদের জানিয়েছে, সে লেখাপড়ার জন্য জাপান গিয়েছিল। সেখানে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তা ছাড়া সেখানকার জীবন ব্যবস্থার সাথে সে খাপ খাওয়াতে না পেরে লেখাপড়া শেষ না করেই দেশে চলে আসে।”
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, “তাঁর বাবা-মা খুবই দরিদ্র। তাই সে দেশে ফিরে এসে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে। সে বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-মাহফিল শুনে বেড়াত। এভাবে সে এক সময়ে ‘সেল্ফ রেডিকালাইজড’ হয়ে পড়ে।”
“জঙ্গি দেলোয়ার সারা বিশ্বের যেমন ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের নিষ্পেষণে খুব কষ্ট পেত। এই কষ্ট থেকে প্রতিশোধ নিতে সে নিজেই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়, যোগ দেয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামে,” যোগ করেন তিনি।
আসাদুজ্জামান বলেন, “মুসলিম দেশ হয়েও বাংলাদেশ সরকার কেন এই নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে কথা বলছে না বা ব্যবস্থা নিচ্ছে না এ জন্য সে ক্ষুব্ধ ছিল। তাই হামলা চালিয়ে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিকল্পনা করে এবং ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তার সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।”
তিনি বলেন, “কিন্তু কূটনৈতিক এলা্কায়, বিশেষ করে আমেরিকান ও থাই দূতাবাসের কাছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এখান থেকে কেউ কোনও ঘটনা ঘটিয়ে পালাতে পারবে না। তাই, সে আক্রমণ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।”
এজাহারে যা বলা হয়েছে
মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুর পৌনে একটার দিকে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ছাত্র পরিবহনের মাইক্রোবাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে এক আক্রমণকারী।
গাড়িতে অবস্থানকারী লোকজন ও স্থানীয় টহল পুলিশ আক্রমণকারীকে আটক করে। পরে তাকে গুলশান থানায় নিয়ে আসলে সে জানায় তার নাম দেলোয়ার হোসেন। বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলায়।
বলা হয়েছে, আটক দেলোয়ারের কাছ থেকে কালো কাপড়ের থলের ভেতর দুটি বড় লোহার ছুরি, দেড় লিটার পেট্রোল সদৃশ তরল পদার্থ, ইংরেজিতে হোসেন দেলোয়ার লেখা একটি জাপানি নাগরিকত্ব কার্ড এবং বাংলাদেশি পাসপোর্টের সাতটি ছেঁড়া পাতা পাওয়া যায়।
এজাহারে বলা হয়, দেলোয়ার ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ পরিচালনার উদ্দেশ্যে এই পেট্রোল বোমা আক্রমণ চালিয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার জানিয়েছে, সে আনসার আল-ইসলামের সক্রিয় সদস্য। সারা বিশ্বের মুসলমানদের ওপর নির্যাতন–নিপীড়ন করা হচ্ছে। সেব্যপারে বাংলাদেশ সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাই সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-স্টাফদের ওপর বড় পরিসরে হামলা করে ব্যাপক প্রাণহানির মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার আরও জানায়, ইউটিউব, ফেসবুক ও বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন উগ্রবাদী ওয়াজ, মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও দেখে সে নিজেই উগ্রবাদী হয়ে ওঠে এবং হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
এই হামলার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা হয়। শুক্রবার আদালতে তোলা হলে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
বেনারের পক্ষ থেকে জাপানে পড়াশোনা করা দেলোয়ারের ব্যাপারে তথ্যের জন্য ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাসে ই–মেইলে যোগাযোগ করা হলেও জবাব পাওয়া যায়নি।
বেনারের পক্ষ থেকে দূতাবাসের কাছাকাছি এলাকায় হামলা সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য সোমবার আমেরিকান দূতাবাসে ই–মেইলে এবং মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জবাব পাওয়া যায়নি।
তবে পুলিশের কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগের কমিশনার আশরাফুল ইসলাম সোমবার বেনারকে বলেন, “এই হামলা নিয়ে মার্কিন দূতাবাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যেম আসামির কাছ থেকে পুরো তথ্য আগে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
মানিকগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহা. হাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “ঢাকায় আটকের পর বৃহস্পতিবার রাতেই কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা দেলোয়ারের গ্রামের বাড়ি সিঙ্গাইরে অভিযান পরিচালনা করেন। তারা দেলোয়ারের কয়েকজন স্বজনকে আটক করে নিয়ে গেছেন। সিটিটিসি বিষয়টি দেখছে।”
তিনি বলেন, “আক্রমণকারী দেলোয়ার কিছুদিন আগে জাপান থেকে ফিরে দেশে চাকরি খুঁজছিল। আমাদের ধারণা, সে চাকরি না পেয়ে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।”
হাফিজুর রহমান বলেন, “দেলোয়ারের বাবা একজন কৃষক। তার দুই বোন আছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নয়।”
সিঙ্গাইরের জামির্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম সোমবার বেনারকে বলেন, দেলোয়ার পাঁচ বছর আগে বৃত্তি নিয়ে জাপানে পড়তে যায়। আমাকে সে কাকা বলে সম্বোধন করত। সে খুব সংস্কৃতিমনা ছিল। তার বাবা-মাও অত্যন্ত ভালো মানুষ। তাকেও খুব ভালো ছেলে হিসেবে জানতাম।”
“কিন্তু বছর খানেক আগে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর সে কারও সাথে দেখা করতো না; কথা বলত না। শুধু ধ্যান করতো,” যোগ করেন ওই চেয়ারম্যান।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বেনারকে বলেন, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেল্লা হত্যাকাণ্ড এবং ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান হামলার পর এই প্রথমবারের মতো গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ায় হামলার চেষ্টা হয়েছে।
তিনি বলেন, খুব ছোট হলেও এই আক্রমণ আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর জঙ্গিরা কতটা উজ্জীবিত, তার একটা প্রমাণ।
মোহাম্মদ আলী বলেন, “কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের হামলা করার কারণ খুব সহজ। এখানে আক্রমণ সফল করতে পারলে সারা বিশ্বের মিডিয়ায় তাদের সম্পর্কে লেখা হতো।”
আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “আমার মনে হয় এই আক্রমণকারী কোনও বড় জঙ্গি নয়। তাকে নতুন কোনও গোষ্ঠী ভাড়া করে মার্কিন ও থাই দূতাবাসের কাছে বোমা হামলা চালানোর পরিকল্পনা করতে পারে।”
“তাকে আমার কাছে বড় জঙ্গি মনে হয়নি, কারণ সে জানে না যে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাথে আমেরিকার সম্পর্ক নেই। যদি সে বড় মাপের কোনও জঙ্গি হতো তাহলে সে সব কিছু জেনেবুঝে এবং রেকি করে সময়মতো আক্রমণ পরিচালনা করতো।”
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “সে আসলে হতাশা থেকে ইউটিউব দেখে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। একজন হতাশ মানুষকে দিয়ে সবরকম কাজ করানো সম্ভব। কারণ সে মনে করে তার জীবনের কোনও দাম নেই। তখন টাকার জন্য সে সবকিছু করবে। কোন পরিণতির কথা ভাববে না।”