জঙ্গিবাদে জড়িয়ে দুই বছরে ঘর ছেড়েছে অর্ধশতাধিক তরুণ
2022.10.10
ঢাকা

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গত দুই বছরে দেশের ১৯টি জেলা থেকে অর্ধশতাধিক তরুণ কথিত হিযরতের নামে বাড়ি ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এসব তরুণ নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’ নামে একটি সংগঠনের হয়ে সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন তথ্য জানিয়ে সোমবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত এক সপ্তাহে এই সংগঠনের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মূলত নতুন করে গত রোববার অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অবহিত করতেই সংবাদ সম্মেলনটি আয়োজন করা হয় র্যাবের পক্ষ থেকে।
এর আগে ঢাকা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘর ছাড়া কয়েক তরুণসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করেছিল র্যাব।
“জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া” নামের সংগঠনকে র্যাব ব্যাখ্যা করে পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার হিসেবে। তারা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংবিধানের পরিবর্তে শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়।
তবে এই নামের বিষয়ে মঈন বলেন, এই নামের মানে কি বা এটা কারা, কীভাবে তৈরি করেছে তা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি জানতে পারেনি র্যাব।
চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে চলছে প্রশিক্ষণ
সংবাদ সম্মেলনে মঈন জানান, বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণের সংখ্যা ৫০ এর অধিক। প্রায় দেড় মাস থেকে দুই বছরের অধিক সময় ধরে তারা নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ।
“এদের মধ্যে কয়েকজনের পরিবার জানে যে, তারা চাকুরীর জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন এবং নিয়মিত পরিবারকে অর্থ পাঠাচ্ছে,” যোগ করেন মঈন।
প্রাথমিকভাবে সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে নিখোঁজদের নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে নাম ও ঠিকানায় কিছুটা তারতম্য থাকতে পারে জানিয়ে এই র্যাব কর্মকর্তা জানান, “এদের বেশিরভাগই পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় আত্মগোপনে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।”
প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত এই তথ্যসমূহ দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন বাহিনীকে জানানোর তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সম্মিলিত অভিযান চলমান রয়েছে।
তিনি জানান, আটককৃত তরুণদের দেয়া তথ্য মতে, দেশের ১৯ জেলার মধ্যে কুমিল্লা থেকে ১৫, সিলেট থেকে সাত, পটুয়াখালী থেকে ছয়, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে চারজন করে, বরিশাল থেকে তিন, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও ঝালকাঠি থেকে দুই, এবং নেত্রকোণা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, মাগুরা, সুনামগঞ্জ, খুলনা, চাঁদপুর, ঝিনাইদহ ও টাঙ্গাইল থেকে একজন করে নিখোঁজ রয়েছেন।
র্যাব জানায়, সর্বশেষ গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজনের মধ্যে রয়েছে সংগঠনের দাওয়াতী ও অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী শাহ মোঃ হাবিবুল্লাহ (৩২)।
জঙ্গিদের টার্গেট তরুণরা
র্যাব জানায়, ইতোমধ্যে আটকৃতদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, জঙ্গিবাদে যোগ দিতে প্রাথমিকভাবে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কোমলমতি তরুণদের সংগঠনের সদস্যরা টার্গেট করত।
“পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন সময় মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ভিডিও দেখানো হয়। বিভিন্ন অপব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে তাদের উগ্রবাদে আকৃষ্ট করা হয়,” যোগ করেন মঈন।
তিনি বলেন, উগ্রবাদে আকৃষ্ট করার পর বিভিন্ন সময়ে তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা রাজনীতি, সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরত। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করার মাধ্যমে তরুণদের সশস্ত্র হামলায় উৎসাহী করে তুলত। এরপর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরামর্শ দিত।
‘প্রয়োজন জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা’
নতুন করে উগ্রবাদের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমরা আগে থেকেই বলছিলাম যে সাময়িকভাবে জঙ্গিবাদের তৎপরতা না দেখা গেলেও উগ্রবাদীদের কর্মকাণ্ড থেমে নেই। এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় অর্ধশত তরুণ হিযরতের নামে বাড়ি ছেড়েছে, যা উদ্বেগজনক।”
বাড়ি ছেড়ে যারা বেরিয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন আটক হওয়াকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “যেহেতু হোলি আর্টিজানের মতো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে, সেহেতু এই বাড়ি ছাড়াটা নিশ্চয়ই উদ্বেগের। কারণ এখন দেখা যাচ্ছে জঙ্গিরা নতুন সংগঠনও তৈরি করছে।”
“আমাদের এখানে সবসময় দেখা গেছে যখনই জঙ্গিবাদ মাথাছাড়া দিয়েছে, তখনই আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো তৎপর হয়েছে। অন্য সময় একটা গা ছাড়া ভাব ছিলো। সূতরাং এটা পরিস্কার যে এডহক ভিত্তিতে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা,“ যোগ করেন তিনি।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন যেহেতু কিছুটা উত্তপ্ত, সেহেতু উগ্রবাদীরা এটিকে সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। তারা সব সময়ই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে।