অব্যাহত হুমকির পর এবার ড. জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা

শরীফ খিয়াম
2018.03.03
ঢাকা
জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের মশাল মিছিল। জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের মশাল মিছিল। ৩ মার্চ ২০১৮।
বেনারনিউজ

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা করেছে এক দুর্বৃত্ত। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের সামনেই নিজের কর্মস্থল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) এই অধ্যাপকের মাথায় রড এবং পিঠে ও হাতে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চের কাছে শনিবার বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, হামলাকারীর নাম ফয়জুর রহমান ফয়জুল (২৪)। গণপিটুনিতে সেও আহত হয়েছে।

“মাগরিবের আজান চলাকালে এই রক্তাক্ত হামলা চালানো হয়। তিনি ছাত্রছাত্রীদের নির্মিত রোবট দেখছিলেন,” বেনারকে জানান ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. আ ক ম মাহবুবুজ্জামান।

“আক্রমণকারী পিছন থেকে এসে তাঁকে আঘাত করে। এ সময় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে সেখানে চারজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তাঁদের সামনেই এ ঘটনা ঘটেছে,” উল্লেখ করেন মাহবুবুজ্জামান।

জাফর ইকবালের এই সহকর্মী বেনারকে আরও বলেন, “পালানোর সময় পুলিশ ও ছাত্ররা হামলাকারীকে ধরে ফেলে এবং বেদম পিটুনি দেয়।”

ঘটনার পর দ্রুতই ড. ইকবালকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।

“তাঁর মাথায় চারটি রডের আঘাত আছে এবং পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাত। তবে তাঁর ব্রেন অক্ষত আছে। অতএব বলা যায়, তিনি আউট অব ডেঞ্জার। তবে যে কোনো সময় তাঁর অবস্থা খারাপ হতে পারে,” বেনারকে জানান শাবিপ্রবি’র স্কুল অব মেডিকেল সায়েন্সের ডিন অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী

নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায়

রাত সোয়া ১০ টায় জাফর ইকবালের অনুজ কার্টুনিস্ট ও রম্য সাহিত্যিক আহসান হাবীব বেনারকে বলেন, “আমার ভাইকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়েছে। আমি এখন তাঁকে দেখতে সম্মিলিত সামরিক হাসাপাতালে (সিএমএইচ) যাচ্ছি।”

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

“প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি (প্রধানমন্ত্রী),” উল্লেখ করেন প্রেস সচিব।

এদিকে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

আক্রমণকারী মাদ্রাসা ছাত্র

ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কুমারগাঁওয়ের বাসিন্দা, সে মাদ্রাসার ছাত্র। তার বামা মওলানা আতিকুর রহমান মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁদের মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া বিভাগ থেকে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

তবে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) পরিতোষ ঘোষ বেনারকে ​বলেন, “তার যে পরিচয়টি পাওয়া গেছে তা যাচাই করে দেখছে পুলিশ।

তিনি বলেন, “গণপিটুনির কারণে তার অবস্থাও ভালো নয়। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। সে একটু সুস্থ হয়ে কথা বলার উপযোগী হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

“সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নয় বলেই আমরা জানতে পেরেছি,” যোগ করেন কমিশনার।

এর আগে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “হামলাকারী মরার মতো পড়ে আছে। কোনো কথার জবাব দিচ্ছে না।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি টিম সিলেট রওনা হয়েছে ।

শঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদের পক্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “বাংলাদেশের ৪৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় শঙ্কিত।”

‘হত্যার উদ্দেশ্যে’ এ হামলা চালানো হয়েছে উল্লেখ করে মি. হারুন এ ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের আইনের আওতায় আনার জন্য তাঁরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।

এর আগে ড. আ ক ম মাহবুবুজ্জামানও বেনারকে বলেন, “এ ঘটনায় শিক্ষকেরা আতঙ্কে আছেন।”

প্রতিবাদ দিকে দিকে

শিক্ষকের ওপর হামলার প্রতিবাদে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মশাল মিছিল করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার জানান, রবিবার বিকেলেও শাহবাগে বিক্ষোভ করবেন তারা।

অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এ ঘটনায় প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে।

মৌলবাদীদের হুমকিতে ছিলেন তিনি

জাফর ইকবালের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর, সিলেটে। তাঁর পিতা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। তাঁর প্রয়াত ভাই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

লেখক হিসেবে জাফর ইকবাল বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। জনপ্রিয় এ শিশুসাহিত্যিকের বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে।

তাঁকে নানা সময়ে ইসলামি মৌলবাদীরা হত্যার হুমকি দিয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেয়। এর আগের বছরও তাঁকেসহ প্রগতিমনা ২০ জনকে হত্যার হুমকি দেয় মৌলবাদীরা।

মৌলবাদীদের হামলায় গত কয়েক বছরে নিহত হন রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং একেএম শফিউল ইসলাম নামে দু’জন শিক্ষাবিদসহ বেশ কয়েকজন লেখক, প্রকাশক, বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।