সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৌলবাদীদের ব্যাপক উপস্থিতি
2018.03.07
ঢাকা

বাংলাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী মতাদর্শ প্রসারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই প্রধান হাতিয়ার হিসেবে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি ব্যবহার করছে বলে মন্তব্য করেছেন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্লেষকরা।
দেশের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ যখন জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন অসংখ্য ব্যক্তি জঙ্গি আক্রমণকে নিন্দা জানানোর পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রপন্থী মন্তব্য পোস্ট করছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “ফেসবুকে মৌলবাদী ও জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রকাশ্য ও গোপনীয় অসংখ্য পেজ এবং গ্রুপ রয়েছে। তাদের নিজস্ব ওয়েব পোর্টালের সংখ্যাও অগণিত। এর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করাই মুশকিল।”
গত বছরের ১৩ মার্চ প্রকাশিত পুলিশ বাহিনীর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের ৮২ ভাগ জঙ্গি ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদের পথে পা বাড়িয়েছে।”
গ্রেপ্তারকৃত ২৫০ জঙ্গির ওপর সমীক্ষা চালিয়ে ওই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী “নতুন সদস্য সংগ্রহ করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে তাদের উৎসাহিত করতে এবং প্রশিক্ষণ দিতে ফেসবুক, টুইটার, ইমো, টেলিগ্রাম, থ্রিমাসহ বিভিন্ন ধরনের মোবাইল অ্যাপস এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে জঙ্গিরা।”
যুক্তিবাদের প্রসারে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে খ্যাতিমান ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট আরিফ জেবতিক বেনারকে বলেন, “অনলাইনে মত প্রকাশের অবাধ সুযোগকে গণতন্ত্রের বিকাশ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিস্তার এবং মৌলবাদ প্রতিরোধে যতটা কাজে লাগানোর কথা ততটা করা যাচ্ছে না। বিপরীতমুখী প্রবণতাই বরং প্রবল।”
এ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী ও মিডিয়া গবেষক আফসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যোগাযোগ মাধ্যমে যা আসছে তা সমাজের বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন। সমাজে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা আছে। জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণের পর ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের লেখায় ও মন্তব্যে সেই অসহিষ্ণুতারই প্রকাশ ঘটছে।”
ভোঁতা ছুরি নিয়ে গেলি কেন?
অধ্যাপক জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় বন্ধু ও সমর্থকদের তোপের মুখে পড়েছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসানুল হক বান্না।
হত্যাচেষ্টাকে সমর্থন করে কানিস ফাতিমা নামে ব্রিটেন প্রবাসী এক নারী হাসানুল বান্নার পোস্টের নিচে মন্তব্য করেছেন, “আপনার মতো চিন্তা যদি রাসুল (সা) সময়ের মানুষদের থাকত তাহলে বদর, ওহুদের যুদ্ধ হতো না।”
গত শনিবার জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর থেকে এমন হাজারো পোস্ট আর কমেন্টে ভরে গেছে ফেসবুক।
দৈনিক কালের কণ্ঠের একটি নিউজের কমেন্টবক্সে জে.এইচ.এম ইয়াসিন খান নামের একজন লিখেছেন, ‘জাবর ষাঁড় মরে নাই? মরলে ভালোই হইতো।’
‘খলিল’ পরিচয়ে একজন লিখেছেন, “একটা নাস্তিকের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, ওর পক্ষে কোনো মুসলমান কথা বলতে পারে না।”
প্রথম আলোর একটি নিউজের কমেন্টবক্সে মোহাম্মদ মারুফ নামে একজন লিখেছেন, “হামলাকারীকে গালাগালি করতে ইচ্ছে করতেছে। তুই ভোঁতা ছুরি নিয়ে গেলি কেন?? একটি ধাঁরালো ছুরি নিয়ে যেতে পারলি না...?”
প্রগতিশীলেরা পিছিয়ে
সামাজিক মাধ্যমে মৌলবাদীরা সংগঠিতভাবে প্রচারণা চালায়। অনলাইন প্রচারণার জন্য দীর্ঘকাল থেকে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীবাহনী এবং বেতনভোগী লোকজন আছে। পক্ষান্তরে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তার পক্ষে যারা লেখালেখি করেন তাঁরা অসংগঠিত।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসারে লেখালেখি করলে একদিকে জঙ্গি হামলা অন্যদিকে আইসিটি আইনে গ্রেপ্তারের আতঙ্ক কাজ করে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মৌলবাদীদের সাথে আপসকামী অবস্থানে থাকায় তাঁদের অনুসারীরা ধর্মান্ধতার বিপক্ষে এবং ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ প্রচারে আগ্রহী হচ্ছে না বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
“সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে ও ব্লগে লেখার পরিবর্তে বিভিন্ন প্রশ্নে দলের পক্ষে জবাব দেওয়া এবং প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করাই দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা তাঁদের প্রধান কাজ মনে করছেন,” বেনারকে বলেন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট বাকি বিল্লাহ।
তিনি বলেন, “বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সখ্য সুস্পষ্ট হওয়ার পর থেকে দলটির সমর্থক এবং ছাত্রলীগের কর্মীদের একটি বড় অংশ মৌলবাদের বিরুদ্ধে যত না বলছে, প্রগতিশীল ঘরানার রাজনৈতিক কর্মী, লেখক ও ব্লগারদের প্রতি তার চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে।”
“অন্যদিকে বিএনপি’র সঙ্গে জামাতসহ অনেকগুলো ইসলামপন্থী দলের জোটবদ্ধ অবস্থান থাকায় ওই দলের কর্মী সমর্থকেরা শুরু থেকেই অনলাইন প্রচারণায় প্রগতিশীলদের বিরোধিতা করে আসছে,” বলেন তিনি।
ব্লগার আরিফ জেবতিক বলেন, “মৌলবাদী গোষ্ঠী শুরু থেকেই সামাজিক মাধ্যমকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। জামাত-শিবির ১০ বছর আগে থেকে পেইড ক্যাম্পেইনার নিয়োগ করে। ২০০৭ সাল থেকে প্রগতিশীল ঘরানার তরুণদের একটি দল ধর্মনিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে প্রচারণায় সক্রিয় হয়। ২০১৩ সালে সরকারের দমনপীড়ন শুরু হলে প্রগতিশীলতার পক্ষে নতুনদের অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। আমরা যারা করতাম এই ফোর্সটা আগের মতো সক্রিয় নেই।”
সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা ও ডিএমপি’র উপকমিশনার আলিমুজ্জামান বেনারকে বলেন, “অসংখ্য ফেসবুক পেজ আছে যেখানে নিয়মিত ধর্মীয় উগ্র মতামত প্রচার করা হয়। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে কথিত জিহাদের প্রতি তরুণদের আকৃষ্ট করা হয়। এগুলো দেখে অনেকেই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। অনেকেই ছদ্মনামে লেখালেখি করায় তাদের তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা কঠিন।”
তিনি বলেন, “কিছু ফেসবুক পেজ, আইডি, ব্লগ ও ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু একটি বন্ধ করা হলে জঙ্গি ও মৌলবাদীরা নতুন নামে আরেকটি পেজ বা আইডি খুলে। এসব মোকাবিলায় গণসচেতনতা দরকার।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বেনারকে বলেন, “ফেসবুকে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারা কী লিখছে সেটা মোকাবিলা করা কোনো রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য যা যা করার আমরা সেটা করছি।”
হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের কারণে দলটির অনুসারীরা সামাজিক মাধ্যমে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সরব ভূমিকা পালন করছে না, এ রকম অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এর সঙ্গে মৌলবাদের সঙ্গে আপোষকামিতার কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো কিছু বাম সংগঠন বলে থাকে।”