পঞ্চগড়ে কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, পুলিশসহ আহত অর্ধশতাধিক

শরীফ খিয়াম
2019.02.13
ঢাকা
190213_Ahmadiyya_Community_1000.JPG পঞ্চগড়ে কাদিয়ানি বসতিতে হামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন। ১৩ জানুয়ারি ২০১৯।
[সৌজন্যে: আহমদিয়া মুসলিম জামা’ত]

পঞ্চগড়ে কাদিয়ানি বা আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের বসতিতে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে কওমি মতাদর্শের উগ্রবাদী মুসল্লিরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মঙ্গলবার রাতে শহরের আহমদনগরে ১৬টি বাড়ি, চারটি দোকান এবং একটি মসজিদ এ আক্রমণের শিকার হয়। এ ঘটনায় ২০ পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন।

এর মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক জানিয়ে জেলার সিভিল সার্জন ও সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বেনারকে বলেন, “তাদের রংপুর মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে।”

ওই হাসপাতালে মোট ৩৭ জন আহতকে চিকিৎসা দেওয়ার কথাও জানান তিনি।

এদিকে বুধবারও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর ফের ‘আক্রমণ’ চালাতে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেন মুসল্লিরা।

পঞ্চগড় আহমদিয়া মুসলিম জামা'তের জ্যেষ্ঠ ধর্মপ্রচারক মাওলানা আব্দুল মতিন বেনারকে বলেন, বুধবার ১১টার দিকে তারা ‘কাফন মিছিল’ বের করলেও আহমদনগর অবধি আসতে পারেনি। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।

“কিন্তু পরিস্থিতি এখনো থমথমে। তারা পুনরায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল-মিটিং করছে,” যোগ করেন তিনি।

আহমদনগরকে কেন্দ্র করে পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কাদিয়ানি বসতি রয়েছে উল্লেখ করে এই কাদিয়ানি নেতা জানান, সেখানকার কয়েক হাজার বাসিন্দা আতঙ্কে রয়েছে।

যদিও জেলার পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ বেনারকে বলেন, “আতঙ্কিত হওয়ার আর কোনো কারণ নেই। পরিস্থিতি এখন শান্ত। সবকিছু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

আহমদনগরে ম্যাজিস্ট্রেটসহ পর্যাপ্ত পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও র‍্যাব (র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) মোতায়েন রয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ইতিমধ্যে কওমিপন্থীদের প্রধান সংগঠন হেফাজতে ইসলাম চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এবং আহমদিয়া মুসলিম জামাত ঘটনাস্থলে সংবাদ সম্মেলন করেছে। উভয় পক্ষই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের দাবি জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে এসপি বলেন, “ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পঞ্চগড় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু আক্কাস আহমদ বেনারকে জানান, পৃথক চারটি মামলা দায়েরে প্রক্রিয়া চলছে।

“তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি,” বলেন ওসি আক্কাস।

বাংলাদেশে প্রায় এক লাখের মতো কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন। কাদিয়ানিরা নিজেদের আহমদিয়া মুসলিম জামা'তের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। তবে সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানেরা তাঁদেরকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করেন না। ফলে এ দেশে তাঁরা মুসলিম সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত।

কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক কট্টরপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার দাবির একটিতে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা করার কথা বলা হয়েছে।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

আহমদিয়া জামা'তের নেতারা জানান, আগামী ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আহমদনগরে বার্ষিক ‘সালানা জলসা’ আয়োজনের জন্য তাঁরা গত ৩১ জানুয়ারি পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নেন। এরই প্রেক্ষিতে ৭ ফেব্রুয়ারি হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী এক বিবৃতিতে, এ আয়োজন বন্ধের পাশাপাশি বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের ‘অমুসলিম’ ঘোষণার দাবি জানান।

পরদিনই (৮ ফেব্রুয়ারি) নবুয়্যত সংরক্ষণ কমিটি, পঞ্চগড় শাখার ব্যানারে পথে নামেন স্থানীয় মুসল্লিরা। তাঁরা ‘সালানা জলসা’–কে ‘কাদিয়ানি ইজতেমা’ ও ‘কাফেরদের আয়োজন’ আখ্যা দিয়ে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু করেন।

পরবর্তীতে পঞ্চগড় যুব সমাজ ও আওয়ামী ওলামা পরিষদ তাদের আন্দোলনে একাত্ম হয়। আন্দোলনকারীরা ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জলসা বাতিলসহ কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানায়।

এক পর্যায়ে তারা জলসাস্থলের পাশেই ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের ঘোষণা দিলে সংকট সমাধানে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কয়েক দফা সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

অন্যদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় উগ্রবাদীরা একই দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘আন্তর্জাতিক মজলিশে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত’ নামের একটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকি দেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার আল্লামা শফী এক বিবৃতিতে বলেন, “যদি এ সম্মেলন (কাদিয়ানিদের জলসা) বন্ধ করা না হয়, প্রয়োজনে আমি পঞ্চগড়ে গিয়ে আন্দোলনে শরিক হব।” গণমাধ্যমে তাঁর এ ঘোষণা প্রকাশের কিছুক্ষণ পরই হামলার ঘটনা ঘটে।

তখনও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কাদিয়ানি ও কওমি নেতাদের নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা চলছিল। পরিস্থিতি সামলাতে রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সাজ্জাত হোসাইন, রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মজিদ আলীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

হামলার খবর পেয়ে বৈঠক স্থগিত রেখেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান তাঁরা। ওই সময় রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, “ঘটনার সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “মুসল্লিদের দাবি ছিল কাদিয়ানিদের জলসা বন্ধ করলে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবে। অথচ প্রশাসন ওই জলসা স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ার পরও তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”

এদিকে বুধবার সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের নামে যারা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুনাম ক্ষুণ্ন করবে তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

“দেশের বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বন্ধন ও সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা হলে কঠোরভাবে দমন করা হবে," যোগ করেন তিনি

তাণ্ডব চলেছে যেভাবে

হামলাকারীরা মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই শহরের চৌরঙ্গীতে জমায়েত হতে থাকে। তারা পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট ও পৌর মেয়র তৌহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে এসে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন।

জেলা প্রশাসনের বৈঠকে জলসা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে জানিয়ে তারা বিক্ষোভকারীদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ারও আহ্বান জানান। কিন্তু তাঁদের উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা কাদিয়ানিদের জলসাস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করলে করতোয়া ব্রিজের ওপর পুলিশ বাধা দেয়।

একটি দল বিকল্পপথে রাজনগর এলাকার ভেতর দিয়ে করতোয়া নদী পার হয়ে আহমদনগরের জলসাস্থলে নির্মাণাধীন প্যান্ডেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। একইসঙ্গে তারা স্থানীয় বাড়িঘর ও দোকানপাটে ভাঙচুর, লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা শুরু করে।

ঘটনার পর ঢাকা থেকে ছুটে যাওয়া আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় নেতা আহমেদ তাফসির চৌধুরী জানান, প্রশাসনের কাছ থেকে জলসা করার অনুমতি নেওয়ার সময়ই পুলিশের কাছে লিখিতভাবে নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছিল। তবুও ঘণ্টাখানেক তাণ্ডব চলার পর পুলিশ এসেছে।

‘আক্রমণকারীরা বহিরাগত

সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট বেনারকে বলেন, “খতমে নবুওয়াতের পক্ষে হামলায় নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অপরিচিত মুখই ছিল বেশি। তারা বহিরাগত বলেই আমার ধারণা।”

“পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত,” বলেও মন্তব্য করেন জেলা আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক।
মাওলানা মতিনের দাবি, “হামলাকারীরা খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ পরিষদ পঞ্চগড়ের ব্যানারে সংগঠিত হলেও উসকানি এসেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে। মূলত হেফাজত ও জাময়াত ইসলাম তাদের সংগঠিত করছে।”

“স্থানীয় হামলাকারীদের অধিকাংশই জামায়াত শিবিরের কর্মী। আমরা প্রায় ৫০জনকে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এ ছাড়া বাইরে থেকে যারা এসেছে, তাদেরও ভিডিওচিত্র আছে আমাদের কাছে,” বলেন তিনি।

পাল্টাপাল্টি বক্তব্য অব্যাহত

বুধবার হাটহাজারীর সংবাদ সম্মেলনে আল্লামা শফী বলেন, “কাদিয়ানিদের তথাকথিত ইজতেমা বন্ধ না হলে পঞ্চগড় অভিমুখে লংমার্চ করা হবে।” এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

আহমদনগরের সংবাদ সম্মেলনে তাফসির চৌধুরী বলেন, “আমরা জলসা আয়োজন করতে চাই। কারণ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো আমাদের লিখিতভাবে নিষেধ করা হয়নি।”

“বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে দেখছি,” সাংবাদিকদের বলেন জেলা প্রশাসক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।