বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয়ের দাবি
2017.04.03
কলকাতা

বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বিষয়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন ও সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বিলুপ্তির আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ভালো নেই বলে সম্মেলনে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও সাংসদ উষাতন তালুকদার। চট্টগ্রামের আদিবাসী এলাকাকে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত করার পরিকল্পনা অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় হিন্দুরা গণহত্যার শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে সম্মেলনের উদ্বোধক, ত্রিপুরার গভর্নর তথাগত রায় বলেন, “দেশ বিভাগের সময় থেকে বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলেছে। এখনো তা অব্যাহত।”
গত ১ ও ২ এপ্রিল কলকাতায় ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে আগামী দিনের কর্তব্য শীর্ষক’ সম্মেলনটির আয়োজন করে ভারতের ‘ক্যাম্পেইন এগেনস্ট এট্রোসিটিজ অন মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশ (ক্যাম্ব)’।
গত ১৫ বছর ধরে সংস্থাটি বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে চলেছে বলে জানিয়েছেন ক্যাম্বের আহ্বায়ক মোহিত রায়।
এই সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শতাধিক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
পশ্চিমবঙ্গকে এগিয়ে আসার আহ্বান
সম্মেলন থেকে অভিযোগ তোলা হয়, বাংলাদেশে ধর্ষণ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে।
ধারাবাহিক ইসলামি আগ্রাসনের পরিণতিতে বাংলাদেশ থেকে কীভাবে হিন্দুরা বিতাড়িত হচ্ছে, কীভাবে তাঁদের সম্পত্তি বেদখল হচ্ছে, এসব বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে। আর এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই এককাট্টা বলে অভিযোগ তুলেছেন বিশিষ্টজনেরা।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা মানবাধিকারকর্মী শীতাংশু গুহ অভিযোগ করেন, “শেখ হাসিনার শাসনামলে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অথচ এসব নির্যাতনের কোনো বিচার হয় না। উল্টো প্রশাসন দুষ্কৃতকারীদের সহায়তা করে।”
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধে মোদি সরকারের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সোচ্চার হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
সম্মেলনের উদ্বোধক তথাগত তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সচেতন হতে হবে। তবেই ভারত সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।”
বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের সভাপতি অ্যাডভোকেট রবীন্দ্র ঘোষও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বাংলাদেশের সমস্যা নিজের মনে করে এগিয়ে আসেন আসার আহ্বান জানান।
মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু অবদানের স্বীকৃতি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুরাই মুসলমানদের চেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা শীতাংশু গুহ।
তিনি বেনারকে বলেন, “পাকিস্তানিদের টার্গেটের শিকার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন। অথচ তারা সেই মর্যাদা পাচ্ছেন না।”
অ্যাডভোকেট রবীন্দ্র ঘোষ বেনারকে বলেন, “যে আদর্শ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম নেই স্পিরিট আজ আর নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হলেও হিন্দুদের অবদানের বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দেয় না।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের আমলে ২৯৩১টি হিন্দু নির্যাতনের ঘটনার ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে দেখেছি সরকার হিন্দুদের অধিকার নিয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। আইনের আশ্রয় নেবারও কোনো সুযোগ নেই।”
বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে
বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার অভিযোগ এনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের প্রতিনিধিরা।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাতের গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণ থেকে জানানো হয়, ১৯৬৪-২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামী দুই দশকের মধ্যে হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলা রিলেশেনস-এর ডিরেক্টর বিমল প্রামাণিক বলেন, “১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৯ শতাংশ। ২০০১ সালে তা ৮.৫ শতাংশে আর ২০১৭ সালে ৭.৪ শতাংশে নেমে এসেছে।”
সম্মেলনের ঘোষণাপত্র
কলকাতা সম্মেলনের শেষ দিনে ১৪ দফার একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। তাতে বাংলাদেশ সরকারকে সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের ওপর হিংসাত্মক আক্রমণ বন্ধ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, বিশেষ ক্ষমতায় হেট ক্রাইম এবং সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার খর্ব করার বিষয় বিচারের জন্য আলাদা শাখা গঠন, সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম কথাটির বিলুপ্তি এবং বৈষম্যমূলক আইসিটি অ্যাক্ট বাতিলের দাবি জানানো হয়।
এ ছাড়া বাজেয়াপ্ত ও দখল হয়ে যাওয়া হিন্দু সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের অবদানকে আলাদাভাবে স্বীকৃতি দেওয়ারও জোর দাবি ওঠে।
সংসদে, সিভিল সার্ভিসে এবং সামরিক বাহিনীতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালু করার দাবিও তোলা হয়েছে ঘোষণাপত্রে।